24 Jun 2018

সিম সোয়াপ থেকে সাবধান! চুরি যেতে পারে টাকা (পার্ট ২)

সিম হারিয়ে গিয়েছে

Photo Credit : Pixabay
এই ব্লগের আগের কিস্তিতে যে পদ্ধতিগুলির কথা বলেছি, ধরা যাক  সেইভাবে কোনও দুষ্কৃতী অবিনাশবাবুর আধার কার্ড নাম্বর, মোবাইল ফোন, বাড়ির ঠিকানা ইত্যাদি জেনে নিল। এরপর শুরু হবে তার আসল কাজ। সে থানায় গিয়ে অবিনাশবাবু সেজে প্রথমে মোবাইল ফোন চুরি যাওয়ার অভিযোগ দায়ের করবে। যে ফোনটি চুরি গিয়েছে তার সিমের নম্বরও দুষ্কৃতী (যেটা আসলে অবিনাশবাবুর নম্বর) পুলিশকে দেবে। পুলিশ সেই অভিযোগ অর্থাৎ এফআইআর গ্রহণ করার পর তার একটি কপি দুষ্কৃতী পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে অবিনাশবাবুর সিমটি যে

নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানির, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
সেই কোম্পানির স্টোরে গিয়ে সে এফআইআর-এর কপি দেখিয়ে বলবে যে, তার ফোনটি চুরি গিয়েছে এবং সেই ফোনে এই নম্বরের সিম (যে সিমটি আসলে অবিনাশবাবুর) ছিল। অবিলম্বে যেন সেই সিমটি ব্লক করে ওই একই নম্বরের নতুন সিম তাকে দেওয়া হয়। নতুন সিম দেওয়ার জন্য কোম্পানি এফআইআর-এর কপি ছাড়াও দুষ্কৃতীর কাছে আধার কার্ডের ফটোকপি চাইবে। দুষ্কৃতী আগেই অবিনাশবাবুর আধার কার্ডের ফটোকপি জোগাড় করেছে। সে সেই ফটোকপি কোম্পানিকে জমা দেবে। 





এক্ষেত্রে আপনার মনে হয়তো প্রশ্ন জেগেছে যে, আধার কার্ডে তো ছবি থাকে, সেক্ষেত্রে দুষ্কৃতীর মুখের সঙ্গে তো অবিনাশবাবুর মুখ মিলবে না। তাহলে তো দুষ্কৃতী ধরা পড়ে যাবে। না, ধরা পড়বে না। এক্ষেত্রে দুষ্কৃতী একটা চালাকি করে। সে অবিনাশবাবুর আধার কার্ডের ফটোকপি নিয়ে সেখানে অবিনাশবাবুর ফটোর জায়গায় একই সাইজের নিজের একটি ফটো আঠা দিয়ে লাগিয়ে তারপর সেটির নতুন করে ফটোকপি করে অর্থাৎ জেরস্ক বের করে। এরফলে নতুন ফটোকপিতে আধার কার্ডে অবিনাশবাবুর জায়গায় দুষ্কৃতীরা মুখ থাকবে। আরও একটি পদ্ধতির আশ্রয় নেয় দুষ্কৃতীরা। সেক্ষেত্রে তারা কারও আধার কার্ডের ফটোকপি প্রথমে কম্পিউটারে স্ক্যান করে। তারপর ফটোশপ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সেই স্ক্যানড কপিতে অন্যের ফটোর জায়গায় নিখুঁতভাবে নিজের ফটো বসিয়ে দেয়। তারপর সেটির প্রিন্ট আউট বের করে। এই কাজগুলি এতটাই নিখুঁত ভাবে দুষ্কৃতীরা করে যে, সাধারণ মানুষ খালি চোখে জালিয়াতিটা ধরতেই পারবে না। দুষ্কৃতীদের চক্রে বিভিন্ন বয়সের লোক থাকে। তাই আধার কার্ডটির আসল মালিক যিনি তাঁর প্রায় সমবয়সী চক্রের কোনও সদস্যকে স্টোরে পাঠানো হয়, যাতে বয়সের ফারাকটা কোম্পানির লোকজন বুঝতে না পারে।

নতুন সিম

দুষ্কৃতী এফআইআর-এর কপি এবং অবিনাশবাবুর আধার কার্ডের ফটোকপি নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানিকে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা আগের সিমটি ব্লক করে দেয়। এবং ওই একই নম্বরের নতুন সিম যেটা তারা দুষ্কৃতীকে দিয়েছে সেটি চালু করে দেয়। এরফলে অবিনাশবাবুর মোবাইলে যে সিমটি রয়েছে সেটিতে আর কোনও নেটওয়ার্ক থাকে না কারণ সেটি ব্লকড হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে দুষ্কৃতী ওই একই নম্বরের নতুন সিম নিয়ে অবিনাশবাবুর নেট ব্যাঙ্কিং অ্যাকাউন্টে লগইন করে। সেক্ষেত্রে দুষ্কৃতী যেহেতু লগইন পাসওয়ার্ড জানে না, তাই সে পাসওয়ার্ড রিসেট করার জন্য ‘ফরগট পাসওয়ার্ড’ অপশনে ক্লিক করে। সেক্ষেত্রে সিকিউরিটি কোয়েশ্চেন কিংবা মোবাইল OTP – র অপশন আসে। যদি দুষ্কৃতী অবিনাশবাবুর সিকিউরিটি কোয়েশ্চেন আন্দাজ করতে পারে বা জেনে যায়, তাহলে তো হয়েই গেল, আর তা না হলে সে মোবাইল OTP অপশনের সাহায্য নেয়। এক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক থেকে পাঠানো OTP পৌঁছে যাবে অবিনাশবাবুর নামে নেওয়া সেই নতুন সিমে যেটি এখন দুষ্কৃতীর কাছে রয়েছে। সেই OTP ব্যবহার করে দুষ্কৃতী সহজেই অবিনাশবাবুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে লগইন করে টাকা সরিয়ে নিতে পারবে।





কাস্টমার কেয়ার থেকে বলছি

সিম আপগ্রেডেশনের মাধ্যমেও সিম সোয়াপ করে দুষ্কৃতীরা। এভাবেই সম্প্রতি অনেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি গেছে।

সিম আপগ্রেডেশন

ধরা যাক সমরবাবুর একটি মোবাইল ফোন রয়েছে যার সঙ্গে তাঁর নেট ব্যাঙ্কিং অ্যাকাউন্ট লিঙ্কড রয়েছে। সমরবাবুর ফোনে যে সিমটি রয়েছে সেটি 3G সিম। সমরবাবুর সিমটি যে কোম্পানির তার কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটিভ সেজে দুষ্কৃতী সমরবাবুকে ফোন করবে। ফোন করে বলবে, ‘আমরা নিখরচায় আপনার 3G সিমটিকে 4G-তে আপগ্রেড করার সুযোগ দিচ্ছি। আপনাকে এই আপগ্রেড করতেই হবে, না হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনার 3G সিমটি ব্লক হয়ে যাবে। আপগ্রেডেশনের জন্য আপনার ফোনে একটি ১৮ ডিজিটের PIN  কোম্পানি থেকে পাঠানো হবে। সেই PIN পাঠানোর পর আমি ভেরিফিকেশনের জন্য আবার আপনাকে ফোন করব। তখন সেই PIN টি আমাকে জানাবেন। তাহলেই আপনার সিম আপগ্রেড হয়ে যাবে।’

সমরবাবু সরল মনে সেই কথা বিশ্বাস করে যদি মোবাইলে আসা PIN দুষ্কৃতীকে জানিয়ে দেন, তাহলেই তাঁর সিম সোয়াপ করতে পারবে দুষ্কৃতীরা। কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব? এর কারণ হল 3G সিমকে যদি 4G সিমে আপগ্রেড করতে হয় তাহলে সিমটি যে কোম্পানির তাদের কাছে আধার কার্ডের নম্বর দিয়ে আবেদন করতে হয়। আবেদনের পর একটি ১৮ ডিজিটের PIN কোম্পানির তরফে গ্রাহকের 3G সিমে পাঠানো হয়। গ্রাহক সেই PIN টি কোম্পানিতে জানালে তখন তাঁর 3G সিমটি ব্লক করে দেওয়া হয় এবং তার বদলে তাঁকে একই নম্বরের একটি নতুন 4G সিম দেওয়া হয়। 

এক্ষেত্রে দুষ্কৃতী প্রথমে সমরবাবুর আধার কার্ডের ফটোকপি কোনও ভাবে জোগাড় করে। তারপর সে সমরবাবু সেজে সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানির কাছে আধার কার্ডের ফটোকপি জমা দিয়ে সিম আপগ্রেডেশনের জন্য আবেদন করে। তারপর সিম আপগ্রেডেশনের জন্য যখন কোম্পানির তরফে সমরবাবুর মোবাইলে PIN পাঠানো হয় তখন সমরবাবুর কাছ থেকে সেই PIN টি জেনে নিয়ে দুষ্কৃতী কোম্পানিকে জানায়। তখন কোম্পানি সমরবাবুর 3G সিমটি ব্লক করে দুষ্কৃতীকে একই নম্বরের একটি নতুন 4G সিম দেয়। দুষ্কৃতী তখন সেই 4G সিমটি ব্যবহার করে সমরবাবুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে লগইন করে টাকা চুরি করে। 

সতর্ক থাকুন

সিম সোয়াপ কী এবং তার মাধ্যমে কীভাবে দুষ্কৃতীরা আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি করতে পারে আশা করি সেই সম্পর্কে এতক্ষণে আপনাদের একটা মোটামুটি ধারণা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল কী কী সাবধানতা অবলম্বন করলে সিম সোয়াপ ঠেকানো যেতে পারে।

১. ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার জন্য বা হেলথ ইনস্যুরেন্স করানোর জন্য ব্যাংক কর্মী পরিচয় দিয়ে কেউ ফোন করলে তাঁদের কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবেন না।

২. আপনার যে কোম্পানির ফোন সেই কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটিভ পরিচয় দিয়ে কেউ যদি আপনাকে সিম আপগ্রেডেশনের অফার দেয় তাহলে তাদের তাদের প্রস্তাবে রাজি হবেন না। যদি বলে সিম আপগ্রেড না করলে সেটি ব্লক হয়ে যাবে তাহলে সেই ব্যক্তির কথায় বিশ্বাস না করে আগে কোম্পানির স্টোরে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিন।

৩. ব্যাংক কর্মী বা মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানির কর্মী পরিচয় দিয়ে কেউ যদি ফোন করে আপনার আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড নাম্বার, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নাম্বার, জন্ম তারিখ, মায়ের বিয়ের আগের নাম ইত্যাদি তথ্য জানতে চায়, তবে কখনোই সেই সমস্ত তথ্য তাদের জানাবেন না।

৪. আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টের
ফটোকপি যখন কোথাও জমা দেবেন, তখন সেই ফটো কপিতে সই করবেন। সই কখনোই ফটোকপির নীচের সাদা অংশে (১ নম্বর ছবি) করবেন না। সর্বদা মূল ডকুমেন্টের উপর দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে করবেন। কীভাবে করবেন তা  (২ নম্বর) ছবিতে দেখে নিন। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ স্বার্থর জন্য কেউ কেউ আপনাকে হয়তো বলতে পারে, এইভাবে আড়াআড়ি সই করলে সেই ফটোকপি বাতিল হয়ে যাবে, কিন্তু তাঁদের কথায় মোটেই কান দেবেন না।

This image is property of teknowbits.blogspot.com


This image is property of teknowbits.blogspot.com



৫. আপনার সিমের নেটওয়ার্ক হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে সতর্ক হন। আপনি যে কোম্পানির সিম ব্যবহার করেন, সেই কোম্পানির সিম সেই এলাকায় অন্য যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদের নেটওয়ার্ক রয়েছে কিনা খোঁজ নিন। যদি দেখেন যে, শুধু আপনার সিমেই নেটওয়ার্ক নেই, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে বিষয়টি জানান। 

৬. আজকাল অনেকেই দুটি বা তার বেশি সিম ব্যবহার করেন। যে সিমটি আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে লিঙ্কড রয়েছে সেটি কখনোই ফেসবুক বা অন্য কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের প্রোফাইলে রাখবেন না। যদি সেই নাম্বারটি আপনি নিজের প্রোফাইলে রাখেন, তবে হাইড অপশন থেকে সেটি হাইড করুন যাতে অন্য কেউ নাম্বারটি দেখতে না পায়।

৭. সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের জন্ম তারিখ সর্বদা হাইড অপশনের সাহায্যে হাইড করে রাখুন।

৮. যদি আপনার দুটি ফোন নাম্বার থাকে তবে যে নাম্বারটি আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে লিঙ্কড রয়েছে, সেই নাম্বারটি আধার কার্ডে দেবেন না। যদি ইতিমধ্যে দিয়ে থাকেন, তবে আধার কার্ডে সেই নাম্বারটি চেঞ্জ করে অন্য নাম্বার দিন। কীভাবে আধার কার্ডে ফোন নাম্বার আপডেট করবেন সেই সম্পর্কে টেকনোবিটসের নতুন পোস্ট কয়েকদিনের মধ্যেই প্রকাশিত হবে। অবশ্যই পড়বেন।


সবশেষে টেকনোবিটসের পাঠকদের কাছে একটি অনুরোধ। আজকের এই পোস্টটি শুধুমাত্র তাঁদের জন্য নয়, যাঁরা টেকনোলজি সংক্রান্ত বিষয় পছন্দ করেন। এই পোস্টটি সর্বসাধারণের সচেতনতার জন্য। তাই সমস্ত পাঠকদের কাছে অনুরোধ, প্রত্যেকে এই পোস্টটি নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে শেয়ার করুন (শেয়ার বাটন পোস্টের নীচেই রয়েছে)। তবে গুগল ব্লগস্পটে এখনও হোয়াটস্অ্যাপ শেয়ারিং বাটন নেই। তাই যাঁরা হোয়াটস্অ্যাপেও পোস্টটি শেয়ার করতে চান, তাঁরা ব্রাউজারের অ্যাড্রেস বার থেকে পোস্টটির URL কপি করে সেটি হোয়াটস্অ্যাপে পোস্ট করতে পারবেন। ধন্যবাদ। 



পোস্টটি পড়ে পছন্দ হলে অবশ্যই টেকনোবিটসের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কমেন্ট করতে ভুলবেন না। ভালো থাকবেন।


অনেক পাঠক অনুযোগ করেছেন, তাঁরা টেকনোবিটসের নতুন পোস্টগুলি সর্বদা তাঁদের ফেসবুকের টাইমলাইনে উপরের দিকে দেখতে পান না। এটা মূলত ফেসবুকের বিশেষ অ্যালগরিদমের জন্য হয়। এই সমস্যা সমাধানের দুটি উপায় আছে —


১. প্রতি সপ্তাহে টেকনোবিটসের অন্তত দুটি পোস্ট প্রকাশিত হয়। তাই সপ্তাহে অন্তত একদিনও যদি আপনারা সরাসরি গুগল সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে টেকনোবিটসের ব্লগসাইটে যান, তবে নতুন পোস্টগুলি পড়তে পারবেন।

২. টেকনোবিটসের ব্লগগুলির লিঙ্ক যখন টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে আমি পোস্ট করি, তখন সেই পোস্টের নীচে আপনারা যদি নিয়মিত কমেন্ট করেন (যদি কমেন্ট করতে ইচ্ছা না হয়, তাহলে অন্তত yes বা no লিখতে পারেন)। তাহলে ফেসবুক অ্যালগরিদম আপনার নিউজ ফিডে টেকনোবিটসের পোস্টগুলি উপরের দিকে শো করবে। 

No comments:

Post a Comment

জনপ্রিয় পোস্ট