24 Jun 2018

সিম সোয়াপ থেকে সাবধান! চুরি যেতে পারে টাকা (পার্ট ১)

অবিনাশ মল্লিকের নেট ব্যাঙ্কিং অ্যাকাউন্ট রয়েছে। খুব সাবধানী লোক। অনলাইনে টাকা লেনদেনের সময় নিজের মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করেন। কখনোই
Image credit : Pixabay
সাইবার কাফের কম্পিউটার ব্যবহার করেন না। শুধু তাই নয়, নিজের ফোনে এবং ল্যাপটপে পেইড অ্যান্টিভাইরাস রয়েছে। সেটি নিয়মিত আপডেটও করেন। অর্থাৎ অনলাইন লেনদেনের ক্ষেত্রে যতরকম সাবধানতা নেওয়া দরকার, অবিনাশবাবু তা নেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবিনাশবাবুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় লাখখানেক টাকা রাতারাতি বেমালুম হাপিশ হয়ে গেল!

একদিন সন্ধ্যাবেলা অবিনাশবাবু লক্ষ্য করলেন, তাঁর ডুয়াল সিমের মোবাইল ফোনে একটি সিমে কোনও নেটওয়ার্ক নেই।
বেশ কয়েকবার ফোনটি সুইচ অন-অফ করলেন, কিন্তু নেটওয়ার্ক এল না। অবিনাশবাবু মনে মনে নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানির (সিমটি যে কোম্পানির) বাপবাপান্ত করলেন — এরা খালি গুণে গুণে টাকা নিতে জানে, কিন্তু পরিষেবা দেওয়ার বেলায় অষ্টরম্ভা। 






অবিনাশবাবু ঠিক করলেন, রাতের মধ্যে যদি নেটওয়ার্ক না আসে, তবে পরদিন সকালেই তিনি কোম্পানির স্টোরে গিয়ে অভিযোগ জানাবেন। পরদিন সকালেও অবিনাশবাবু দেখলেন নেটওয়ার্ক আসেনি। প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। কারণ তাঁর ছেলে বাইরে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। তাকে অনলাইনে টাকা পাঠানো দরকার। কিন্তু নেটব্যাঙ্কিং-এ অনলাইন লেনদেনের সময় OTP (One Time Password) যে সিমটিতে আসে সেই সিমটিতেই গতকাল সন্ধ্যা থেকে নেটওয়ার্ক নেই। বিরক্ত অবিনাশবাবু ঠিক করলেন, কোম্পানির স্টোরে গিয়ে অভিযোগ জানানোর আগে তিনি একবার ব্যাঙ্কে যাবেন। ছেলেকে টাকা পাঠানোটা জরুরি। নেটব্যাঙ্কিং যখন হচ্ছে না, তখন ব্যাঙ্ক থেকেই ছেলের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠাতে হবে।

কিন্তু অবিনাশবাবু জানতেন না ব্যাঙ্কে তাঁর জন্য কী দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। ছেলেকে টাকা পাঠানোর আগে ব্যাঙ্কে গিয়ে পাশবুক আপডেট করলেন অবিনাশবাবু। পাশবুক আপডেট করে যা দেখলেন তাতে তাঁর মাথা ঘুরে গেল। অবিনাশবাবুর অ্যাকাউন্টে ১ লাখ ৭ হাজার টাকা ছিল। কিন্তু পড়ে আছে মাত্র ১২০০ টাকা!

কীভাবে এটা সম্ভব হল? আসলে পুরোটাই সিম সোয়াপ (একই নম্বরের পুরানো সিম ব্লক করে নতুন সিমের রেজিস্ট্রেশন) পদ্ধতির কেরামতি। অবিনাশবাবুর সঙ্গে যেটা হয়েছে, কাল সেটা কিন্তু আমার আপনার সঙ্গেও ঘটতে পারে। সুতরাং সাবধান।

কীভাবে দুষ্কৃতীরা সিম সোয়াপ পদ্ধতিতে টাকা চুরি করে?




এক্ষেত্রে তারা আমাদের অসচেতনতার সুযোগ নেয়। ঠিকানা ও পরিচয়পত্রের প্রমাণ হিসেবে এখন নানা কাজে আমরা নিজেদের আধার কার্ড, প্যান কার্ড এবং ব্যাঙ্কের পাশবুকের প্রথম পাতার ফটোকপি (যাকে প্রচলিত ভাষায় ‘জেরক্স’ বলা হয়, যদিও জেরক্স হল একটি কোম্পানি যাঁরা ফটোকপি মেশিন তৈরি করে) বিভিন্ন জায়গায় জমা দেই। যারা সিম সোয়াপ পদ্ধতিতে টাকা চুরি করে, তারা প্রথমে আমাদের জমা দেওয়া সেই ফটোকপি জোগাড় করে। কীভাবে জোগাড় করে? আমরা ওই সমস্ত ডকুমেন্টের ফটোকপি যে সমস্ত অফিসে জমা দেই সেখান থেকেই তা চুরি হয়। কিংবা ধরুন আপনি আপনার পাড়ার দোকানে নতুন সিম নেওয়ার জন্য বা MNP (মোবাইল নাম্বার পোর্টাবিলিটি) করার জন্য যে সমস্ত ডকুমেন্টের ফটোকপি জমা দিয়েছেন, সেখান থেকেও সেগুলি চুরি যেতে পারে। চুরি যাওয়া মানে আমি বলতে চাইছি, আপনার ডকুমেন্টের ফটোকপিগুলির ফের ফটোকপি করে নেওয়া হয়। 


আপনি হয়তো বলবেন, কীভাবে সেটা সম্ভব। কারণ আপনি যখন আপনার ডকুমেন্টের ফটোকপি জমা দিচ্ছেন, তখন সেখানে তো সই করছেন। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আমরা যখন আধার, প্যান, ভোটার কার্ড এবং ব্যাঙ্কের পাশবুকের প্রথম পাতার ফটোকপি কোথাও জমা দেই, তখন সেগুলিতে সই করি। কিন্তু সই করার সময় আমরা অনেকেই একটি বড় ভুল করি। 

কী সেই ভুল?

সেটা হল ফটোকপির কাগজের নীচের দিকে সাদা জায়গায় আমরা সই করি। আর এর সুযোগ নেয় দুষ্কৃতীরা। আপনি ফটোকপির নীচের দিকে যে সাদা জায়গায় সই করেন, সেই জায়গাটি কাগজ দিয়ে ঢেকে নিয়ে বা ছিঁড়ে ফেলে ফের সেই ফটোকপির নতুন করে ফটোকপি করে নেওয়া হয়। ফলে নতুন ফটোকপিতে আর আপনার সই থাকে না।

ভুয়ো কল

অনেক সময় এমন হয় যে, দু্ষ্কৃতীরা আপনার প্যান কার্ড বা আধার কার্ডের ফটোকপি জোগাড় করেছে কিন্তু আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নম্বর জানতে পারেনি। সেক্ষেত্রে
Photoe credit : Pexels
তারা ভুয়ো কলের আশ্রয় নেয়। সাধারণত এই ধরনের ভুয়ো কলের ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীরা নিজেদের কোনও ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড ডিপার্টমেন্টের কর্মী বা হেল্থ ইনশ্যুরেন্স ডিপার্টমেন্টের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেয়। তারা ফোন করে বলে যে, তাদের ব্যাঙ্কের তরফে আপনাকে ফ্রিতে ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হবে বা খুব কম প্রিমিয়ামে ইনশ্যুরেন্সের সুবিধা দেওয়া হবে। অনেকেই দুষ্কৃতীদের সেই ফাঁদে পা দেন। আপনি যদি তাদের প্রস্তাবে রাজি হন, তখন দুষ্কৃতীরা আপনাকে বলবে, ব্যাঙ্কের তরফে আপনার আইডেন্টিটি ভেরিফাই করার জন্য কিছু প্রশ্ন করা হবে, আপনাকে সেই প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর দিতে হবে। 
প্রশ্নগুলি কী কী?

যেমন, আপনার জন্ম তারিখ, আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নাম্বার, আপনার মায়ের বিয়ের আগের নাম এবং আপনার প্যান কার্ড নাম্বার। সাধারণত দুষ্কৃতীরা এই চারটি প্রশ্ন করে। জেনে রাখুন, এই চারটি প্রশ্নের মধ্যে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নাম্বার এবং বিয়ের আগে আপনার মায়ের নাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেট ব্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে পাসওয়ার্ড ভুলে গেলে নতুন পাসওয়ার্ড সেট করার জন্য ‘সিকিউরিটি কোয়েশ্চেন’ হিসেবে গ্রাহকের মায়ের বিয়ের আগের নাম (পদবি সহ) জানতে চাওয়া হয়।

ফোন নম্বর

দুষ্কৃতীরা আপনার ফোন নম্বর জোগাড় করে কীভাবে? এখন ফোন নম্বর পাওয়া খুব সহজ। আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা পরিচয়ের প্রমাণ পত্র হিসেবে আধার কার্ডের ফটোকপি বিভিন্ন জায়গায় জমা দেই। সেখান থেকেই দুষ্কৃতীরা সহজে আপনার ফোন নম্বর জেনে নিতে পারে। এছাড়া অনেকে তাঁদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের প্রোফাইলে ফোন নাম্বার দেন এবং সেটি হাইড করেন না। সেখান থেকেও দুষ্কৃতীরা ফোন নাম্বার জানতে পারে।

সোশ্যাল মিডিয়া সার্ভে

যারা দাগি দুষ্কৃতী, তার সিম সোয়াপের মাধ্যমে প্রতারণার ক্ষেত্রে অনেক আটঘাট বেঁধে কাজে নামে। মানে আমি বলতে চাইছি যে, তারা যে ব্যক্তিকে তাদের শিকার হিসেবে টার্গেট করে, তাঁর ব্যাঙ্কে কত টাকা থাকতে পারে তা জানার জন্য রীতিমত সার্ভে বা সমীক্ষা চালায়। ধরা যাক দুষ্কৃতীরা আপনার আধার কার্ডের ফটো কপি থেকে আপনার নাম ও ঠিকানা পেয়ে গিয়েছে। এবার সেই নাম ও ঠিকানা দিয়ে তারা অনলাইনে সার্চ করে আপনার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট খোঁজে। ধরা যাক আপনার ফেসবুকে বা ইনস্টাগ্রামে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এবার আপানার সেই অ্যাকাউন্ট গিয়ে দুষ্কৃতীরা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে আপনি কেমন লাইফ স্টাইল মেইন্টেন করেন। এটা অস্বীকার করে লাভ নেই যে, আমাদের অনেকের মধ্যে যথেষ্ট আদেখলাপনা রয়েছে। আমরা অনেকেই বড় কোনও রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে সেলফি তুলি, প্লেনে চড়ার সময় সেলফি তুলি, নতুন গাড়ি কিনলে তার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলি। তারপর সেগুলি নিজেদের সোশ্যাল অ্যাকাউন্টে পোস্ট করি। দুষ্কৃতীরা যে ব্যক্তিকে টার্গেট করে, তাঁর অ্যাকাউন্টে গিয়ে মূলত এই ধরনের কী কী ছবি রয়েছে তা দেখে নেয়। যদি তারা দেখে যে, আপনি ঘন ঘন বড় রেস্তরাঁয় খেতে যান, প্রায়ই শপিংমলে গিয়ে কেনাকাটা করেন, কিংবা আপনার গাড়ি আছে, বা আপনার ফ্ল্যাটে দামি ফার্নিচার রয়েছে, তাহলে সেই সমস্ত ছবি দেখে আপনার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স সম্পর্কে তারা একটা আন্দাজ করে। যদি সেই সমস্ত ছবি দেখে তাদের মনে হয় আপনার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স যথেষ্ট ভালো অর্থাৎ আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মোটা টাকা থাকার সম্ভাবনা বেশি, তখন তারা তাদের কাজ শুরু করে…. 



আজকের এই পোস্টটি শুধুমাত্র তাঁদের জন্য নয়, যাঁরা টেকনোলজি সংক্রান্ত বিষয় পছন্দ করেন। এই পোস্টটি সর্বসাধারণের সচেতনতার জন্য। তাই সমস্ত পাঠকদের কাছে অনুরোধ, প্রত্যেকে এই পোস্টটি নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে শেয়ার করুন (শেয়ার বাটন পোস্টের নীচেই রয়েছে)। তবে গুগল ব্লগস্পটে এখনও হোয়াটস্অ্যাপ শেয়ারিং বাটন নেই। তাই যাঁরা হোয়াটস্অ্যাপেও পোস্টটি শেয়ার করতে চান, তাঁরা ব্রাউজারের অ্যাড্রেস বার থেকে পোস্টটির URL কপি করে সেটি হোয়াটস্অ্যাপে পরিচিতদের পাঠাতে পারবেন। 

পোস্টটি পড়ে পছন্দ হলে অবশ্যই টেকনোবিটসের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কমেন্ট করতে ভুলবেন না। ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।

অনেক পাঠক অনুযোগ করেছেন, তাঁরা টেকনোবিটসের নতুন পোস্টগুলি অনেক সময় তাঁদের ফেসবুকের টাইমলাইনে উপরের দিকে দেখতে পান না। এটা মূলত ফেসবুকের বিশেষ অ্যালগরিদমের জন্য হয়। এই সমস্যা সমাধানের দুটি উপায় আছে —

১. প্রতি সপ্তাহে টেকনোবিটসের অন্তত দুটি পোস্ট প্রকাশিত হয়। তাই সপ্তাহে অন্তত একদিনও যদি আপনারা সরাসরি গুগল সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে টেকনোবিটসের ব্লগসাইটে যান, তবে নতুন পোস্টগুলি পড়তে পারবেন।

২. টেকনোবিটসের ব্লগগুলির লিঙ্ক যখন টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে আমি পোস্ট করি, তখন ফেসবুকে সেই পোস্টের নীচে আপনারা যদি নিয়মিত কমেন্ট করেন (যদি কমেন্ট করতে ইচ্ছা না হয়, তাহলে অন্তত yes বা no লিখতে পারেন)। তাহলে ফেসবুক অ্যালগরিদম আপনার নিউজ ফিডে টেকনোবিটসের পোস্টগুলি উপরের দিকে শো করবে।

6 comments:

  1. Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এই রকম একটি দরকারি বিষয়ে লেখার জন্য।

      Delete
  2. Thanks you....sir Post korar jonno

    ReplyDelete
  3. Thank you for this type of information

    ReplyDelete

জনপ্রিয় পোস্ট