22 Oct 2017

ই-সিম



Photo Credit : Pixabay

আমার পাশের ফ্ল্যাটের সৌগত কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে কলকাতার একটি নামী কলেজে পড়ছে সম্প্রতি পুজোর ছুটিতে সে বাড়ি এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা হতেই হেসে বলল, ‘দাদা, এবার পুজোয় জামাকাপড় কিছু কিনিনি অনলাইনে পুজো স্পেশাল অফারে এই ফোনটি কিনেছি,’ — সৌগত পকেট থেকে একটি দামি স্মার্ট ফোন বের করে দেখাল আমি দেখে বললাম, ‘বাহ্, বেশ ভালো হয়েছে! কিন্তু তুমি স্যাটিসফায়েড তো?’ সৌগত একটু বেজার মুখ করে বলল, ‘পুরোপুরি নই
ফোনটির সবই ঠিক আছে, কিন্তু একটাই সমস্যা আমি হেসে বললাম, ‘হাইব্রিড সিম স্লট?’ সৌগত সায় দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ দাদা, ঠিকই ধরেছেন। কী করা যায় বলুন তো?’ আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘কিচ্ছু করার নেই। শুধু তোমার ফোনে নয়, আজকাল অনেক ফোনেই এই সমস্যা। যদি এসডি মেমরি কার্ড ব্যবহার করতে চাও, তবে দুটি সিম তুমি কখনোই একসঙ্গে ফোনে ব্যবহার করতে পারবে না। তবে অদূর ভবিষ্যতে এই সমস্যা মিটে যাবে।’ ‘তাই! কীভাবে?’— সৌগতর প্রশ্ন। আমি উত্তর দিলাম, ‘ই-সিম—এর মাধ্যমে।’

-সিম (eSIM) কী? 

এর পুরো নাম হল (Embedded Subscriber Identity Module) প্রচলিত সিম কার্ড যেগুলি এখন আমরা ফোন, ডঙ্গল, পোর্টেবল রুটার সহ বিভিন্ন ডিভাইসে ব্যবহার করি, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সেই সিম কার্ডের বদলে আমরা ব্যবহার করব eSIM
২০১৭ সালের বার্সেলোনা মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে (MWC) অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল ই-সিম। কিন্তু কেন ই-সিম নিয়ে টেকনোলজির দুনিয়ায় এখন এত আলোচনা চলছে? এর কারণ আগামী দিনে ই-সিম প্রযুক্তি শুধু যে গ্রাহক, নেটওয়ার্ক সার্ভিস অপারেটর বা ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলিকেই যথেষ্ট সুবিধা দেবে — তাই নয়, একই সঙ্গে এই প্রযুক্তি পরিবেশ দূষণও কমাবে।
স্মার্ট ফোন বা ট্যাবের টেকনোলজি এখন প্রায় প্রতিদিনই উন্নত হচ্ছে। আজ আপনি যে স্মার্ট ফোনটি কিনেছেন, ছয় মাস পর সেই দামে তার চেয়ে উন্নত স্পেসিফিকেশনের ফোন বাজারে চলে আসবে। কিন্তু শুধু টেকনোলজি নয়, একই সঙ্গে আরও একটি বিষয়ের উপর ফোন কোম্পানিগুলি গুরুত্ব দিচ্ছে, তা হল ফোনের গেট আপ। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে ফোন বা ট্যাব যত স্লিম, সেই ফোন বা ট্যাব দেখতে তত ভালো এবং ক্রেতাদের মধ্যে তার চাহিদাও তত বেশি। তাই স্মার্ট ফোনের গেট আপ-এর ক্ষেত্রে এখন আলট্রা থিন কনসেপ্ট চলছে। অর্থাৎ ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলির এখন নীতি হল, ফোনের প্রসেসর, মেমরি, ব্যাটারি ব্যাক আপ উন্নত করার পাশাপাশি ফোনটি যেন যতটা সম্ভব পাতলা বা স্লিম হয়। এই পরিস্থিতিতে এখন ফোন তৈরির ক্ষেত্রে স্পেস ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ফোন তৈরির ক্ষেত্রে যদি ১ থেকে ২ মিলিমিটার স্পেসও বাঁচানো সম্ভব হয়, তবে সেটাই কোম্পানিগুলির কাছে অনেক বড় ব্যাপার।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ফোনের ভেতর অনেকটা জায়গা নিয়ে নিচ্ছে সিম কার্ড স্লট। তাই জায়গা বাঁচানোর জন্য সিমের সাইজ গত কয়েক বছরে ক্রমশ ছোটো করা হয়েছে। সাধারণ সাইজের সিম কার্ডের বদলে প্রথমে এসেছে মাইক্রো সিম আর এখন চলছে ন্যানো সিম। কিন্তু তাতেও সমস্যা পুরোপুরি মিটছে না। ন্যানো সিমের জন্য দুটি আলাদা স্লট রাখার পাশাপাশি এসডি কার্ডের জন্যও আরও একটি স্লট রাখতে গিয়ে ফোনের ভেতর অনেকটা স্পেস অপচয় হচ্ছে। সেই স্পেস বাঁচানো গেলে ফোনের মাদারবোর্ডের কর্মক্ষমতা যেমন বাড়ানো যেত, তেমনি ফোনের গেট আপ আরও স্লিম করা যেত বলে কোম্পানিগুলির দাবি। এই পরিস্থিতিতে সমস্যা কিছু পরিমাণে মেটাতে কয়েকটি কোম্পানি এখন ফোনে হাইব্রিড স্লটের ব্যবস্থা করেছে। সিমের জন্য দুটি এবং এসডি কার্ডের জন্য একটি — মোট তিনটি স্লট না রেখে দুটি স্লট রাখা হচ্ছে, যার মধ্যে একটি স্লটে শুধু সিম এবং অন্য স্লটে এসডি কার্ড বা সিম রাখা যাবে। কিন্তু তাতে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। আজকাল অনেকেরই দুটি সিম, তা ছাড়া অধিকাংশ ফোনেই মেমরি সাইজ প্রয়োজনের তুলনায় কম। তাই বেশিরভাগ গ্রাহকই চান ফোনে দুটি সিম রাখার পাশাপাশি এসডি কার্ডও রাখতে। কিন্তু হাইব্রিড স্লট তাঁদের সেই সুবিধা দিচ্ছে না।
তাহলে উপায়?

সমস্যা মেটাবে ই-সিম

টেকনোলজির দুনিয়ায় অধিকাংশ প্রযুক্তির উদ্ভাবক অ্যাপল। অ্যাপল যেহেতু উন্নত প্রযুক্তির পাশাপাশি ডিভাইসের গেট আপের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়, তাই সিম কার্ড স্লটের বিকল্প নিয়ে তারাই প্রথম চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলসেই চিন্তাভাবনার ফসল হল ই-সিম। বেশ কয়েক বছর আগে অ্যাপল প্রথম তাদের আইপ্যাডে ই-সিম প্রযুক্তি চালু করে। এই সিমের নাম তারা দেয় অ্যাপল সিম। এক্ষেত্রে আইপ্যাডে আলাদা কোনো সিম কার্ড স্লট রাখা হল না। অর্থাৎ সিম কার্ড স্লটের জন্য যে স্পেস নষ্ট হত, তা বাঁচল। তাহলে সিম কার্ড কোথায় থাকবে? অ্যাপল সিম কার্ডটিকে আইপ্যাডের মাদার বোর্ডে সার্কিটের সঙ্গে পেস্ট (এমবেড) করে দিল। অর্থাৎ মাদারবোর্ডে যেভাবে আইসি চিপ, ক্যাপাসিটর ইত্যাদি পেস্ট করা হয়, সেইভাবে সিম কার্ডটিকেও পেস্ট করা হল। বর্তমানে অ্যাপলের আইপ্যাডের একাধিক মডেলে ‘অ্যাপল সিম’ বা ই-সিম প্রযুক্তি রয়েছে।
অ্যাপলের এই নতুন প্রযুক্তি অন্যান্য মোবাইল ও ট্যাব ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির মধ্যে যেমন সাড়া ফেলল, তেমনি বিষয়টি ভাবিয়ে তুলল GSMA-কে। GSMA-র ফুল ফর্ম Global System for Mobile Communications Agency ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার সদর দপ্তর লন্ডন। বিশ্বের প্রায় ১২০০টি মোবাইল নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানি (যেমন, আমাদের দেশে আইডিয়া, ভোডাফোন, এয়ারটেল ইত্যাদি) এই সংস্থার সদস্য। বর্তমানে সংস্থার চেয়ারম্যান ভারতী এন্টারপ্রাইজ তথা এয়ারটেল কোম্পানির চেয়ারম্যান সুনীল মিত্তাল। মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির স্ট্যান্ডার্ড থেকে শুরু করে সিম কার্ডের মাপ কী হবে সেই সমস্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় GSMAসেই সিদ্ধান্ত সংস্থার সদস্য কোম্পানিগুলি মেনে চলে। অ্যাপল যখন তাদের নিজেদের মতো করে ই-সিম প্রযুক্তি চালু করলো, তখন GSMA বুঝতে পারলো আগামী দিনে এই প্রযুক্তির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে তারাও চিন্তাভাবনা শুরু করলো এবং তাদের নিজেদের মতো করে ই-সিম প্রযুক্তির নতুন স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করলো। সেই স্ট্যান্ডার্ড মেনে ২০১৬ সালে স্যামসাঙ তাদের Gear S2 Classic 3G হ্যান্ডসেটে ই-সিম প্রযুক্তি ব্যবহার করলো। এই উদ্যোগে সামিল হল গুগল কোম্পানিও। চলতি বছর তারা পিক্সল সিরিজের যে ফোনগুলি নিয়ে এসেছে, সেগুলির মধ্যে Pixel 2 এবং Pixel 2 XL হ্যান্ডসেটে ই-সিম প্রযুক্তি রয়েছে। ইতিমধ্যে অ্যাপল গত মাসে তাদের যে নতুন স্মার্ট ওয়াচ (সিরিজ থ্রি) লঞ্চ করেছে তার মধ্যেও রয়েছে অ্যাপল সিম তথা ই-সিম প্রযুক্তি।

-সিম এর সুবিধা কী?

প্রথমত, ই-সিম ব্যবহার করলে ফোন, ট্যাব বা স্মার্ট ওয়াচে সিম কার্ড স্লটের জন্য আলাদা স্পেস রাখতে হয় না। ফলে সেই স্পেস অন্য কাজে ব্যবহার করে ফোন কোম্পানিগুলি ফোনের স্পেসিফিকেশন যেমন উন্নত করতে পারবে, তেমনি ফোনের গেট আপ আরও স্লিম করতে পারবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইন্টারনেটের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। ফলে আগামী দিনে ডট পেন, সানগ্লাস থেকে শুরু করে থার্মোমিটার, আঙটি — সবকিছুই ইন্টারনেট কানেক্টেড থাকবে। অর্থাৎ IoT (Internet of Things)—এর ব্যবহার আমাদের জীবনে ক্রমশ বাড়বে। যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই IoT-র সাইজ এমন যে (যেমন ধরুন থার্মোমিটার), তাতে সাধারণ সিম কার্ড ব্যবহার করা সম্ভব নয়, তাই সেক্ষেত্রে ই-সিম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।
তৃতীয়ত, ই-সিম হল রিরাইটেবল। তাই এই সিম ব্যবহার করলে MNP (Mobile Number Portability) পরিসেবা পেতে গ্রাহকদের সুবিধা হবে। ধরুণ আপনি A কোম্পানির গ্রাহক, কিন্তু MNP করে B কোম্পানির গ্রাহক হতে চান। সেক্ষেত্রে এখন আপনাকে A কোম্পানির সিম ফেলে নতুন করে B কোম্পানির সিম নিতে হয়কিন্তু ই-সিম থাকলে সেই সমস্যা হবে না। আপনার ফোনে এসএমএস-এর মাধ্যমে বিশেষ কোড পাঠিয়ে ই-সিম থেকে A কোম্পানির সমস্ত ডেটা মুছে দিয়ে B কোম্পানি তাদের ডেটা রাইট করে সিমটিকে অ্যাকটিভ করে দেবে।
চতুর্থত, কোন ফোন মাইক্রো সিম সাপোর্ট করবে, কোন ফোন ন্যানো সিম সাপোর্ট করবে সেই সব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন থাকবে না, বা সেই অনুসারে সিম অ্যাডাপটর কেনা বা দোকানে গিয়ে সিম কাটিয়ে নেওয়ার ঝামেলাও থাকবে না।
                এছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পরিবেশ দূষণ। সিম কার্ড তৈরি করা হয় প্লাস্টিক দিয়ে। বিশ্বে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ সিম কার্ড পুরানো হয়ে যাওয়ায় বা ব্যবহার না করায় ফেলে দেওয়া হয়। যেহেতু কার্ডগুলি প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি তাই সেগুলি পচনশীল নয়, পরিবেশে জমতে থাকে এবং দূষণ ঘটায়। প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের মতো তাই সিম কার্ডের দূষণও এখন একটি বড় সমস্যা। ই-সিম চালু হলে সেই সমস্যাও মিটবে।

2 comments:

  1. অনেক দিনের আশা ছিলো টেকনোবাইটসের একটা ওয়েবসাইট পাবো । অবশেষে তা পেলাম !! কিছু মনে করবেন না, আপনার দেওয়া তথ্য গুলো জানলে বা পড়লে কিংবা মনে রাখলে নিজেকে আপডেট রাখা যায় ঠিকই কিন্তু কাজে আসে সামান্যই !!! ( আমি দু:খিত আপনাকে এভাবে বলছি ) তাই আপনাকে অনুরোধ করবো , আপনি এমন কিছু আমাদের সামনে উপস্থাপন করুন বা পোস্ট করুন যা আমাদের অত্যন্ত দরকারি !! ( কিছু মনে করবেন না, ভাইরাস সংক্তান্ত্ অনেক তথ্য আমরা আপনার কাছে পেয়েছি এবার ওসব একটু কমিয়ে দিন )

    যেমন ধরুন, কিভাবে ইনটারনেটকে কাজে লাগিয়ে জোরগার করা যায়,কিভাবে কম্পিউটার কাজ করে কিভাবে হ্যাকিং করে, এই সব বলুন !!

    ইন্দ্র দা, আমি একজন সাধারন পাঠক হিসেবে আপনাকে কথাটা বললাম !! হয়তো এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি । তবে সবটাই আপনার ব্যাক্তিগত । আমাকে ক্ষমা করবেন ।

    - জয়হিন্দ

    ReplyDelete
  2. হয়তো এই সব অকাজের তথ্যগুলি অধিকাংশ পাঠকের পছন্দ, তাই টেকনোবিটসের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।
    কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন কীভাবে কাজ করে সেই বিষয়ে টেকনোবিটসের পাতায় (সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংস্করণে) গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন ভাবে বহুবার আলোচনা হয়েছে। ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে কীভাবে রোজগার করা সম্ভব সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এই বছরেই — ফিচারটির নাম ছিল ‘ডিজিটাল আনলকড্’। হ্যাকিং শিখতে গেলে যথেষ্ট পড়াশোনা করতে হয়, ইন্টারনেটে বিভিন্ন সাইটে প্রকাশিত ফিচার পড়ে হ্যাকিং শেখা যায় না। তা ছাড়া টেকনোবিটস একটি দায়িত্বশীল ফিচার পেজ যা ভারত সরকারের সাইবার ল’ কঠোরভাবে মেনে চলে, তাই সেখানে হ্যাকিং নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা কখনোই সম্ভব নয়। আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete

জনপ্রিয় পোস্ট