2 Feb 2019

টাকার লোভ দেখিয়ে তথ্য হাতানোর নতুন ছক ফেসবুকের

Image Credit: Facebook

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে দামি ও গুরুত্বপূর্ণ কী? না, পেট্রল, সোনাদানা ওসব কিছু নয়। উত্তরটা হল ডেটা অর্থাৎ তথ্য। যে তথ্য প্রতিমুহূর্তে আমি, আপনি উৎপাদন (জেনারেট) করছি আমাদের সারাদিনের বিভিন্ন কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে। আমার, আপনার জেনারেট করা সেই ডেটা নিয়ে ব্যাবসা করেই গুগল, ফেসবুক বা তাদের মতো অন্যান্য কোম্পানি প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার মুনাফা করছে। তাই এই ডেটা এতটাই দামি যে, তা পাওয়ার জন্য টেক কোম্পানিগুলি আইন না মেনে যে কোনও সীমা পর্যন্ত যেতে পারে। আর সাম্প্রতিক কালে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল ফেসবুক।




ওনাভো অ্যাপ


কী করেছে ফেসবুক? সেটা বলতে গেলে আমাদের কিছুটা পিছিয়ে যেতে হবে। কারণ ঘটনাটা শুরু হয়েছিল প্রায় পাঁচ বছর আগে যখন ফেসবুক ১২ কোটি ডলার দিয়ে ওনাভো (Onavo) অ্যাপ কোম্পানিকে কিনেছিল। ওনাভো ফ্রি ভিপিএন অ্যাপ। অর্থাৎ এই অ্যাপটির সাহায্যে আপনি যদি ইন্টারনেট সার্ফ করেন, তবে আপনার সমস্ত ওয়েব অ্যাক্টিভিটি (অর্থাৎ কোন কোন সাইট আপনি সার্ফ করছেন, কোন কোন লিঙ্কে ক্লিক করছেন, কোন কোন অ্যাপ সারা দিনে কতক্ষণ ব্যবহার করছেন, কোন অ্যাপের মাধ্যমে কাকে দিনে কতগুলি মেসেজ পাঠাচ্ছেন ইত্যাদি) এবং আইডেন্টিটি (আপনার মোবাইল ফোনের জিওগ্রাফিক লোকেশন, ফোনের বা ট্যাবের সিম ও মডেল নাম্বার ইত্যাদি)সরকারের নজরদারি সংস্থাগুলি বা অন্য কেউ জানতে পারবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হল ওনাভো ঠিক এর উলটোটাই করত।


ওনাভো প্রোটেক্ট


ফেসবুক ওনাভো কোম্পানিকে কেনার পর ‘ওনাভো প্রোটেক্ট’ নাম দিয়ে অ্যাপটিকে গুগল প্লে স্টোরে ও অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে নতুন করে লঞ্চ করেছিল। অ্যাপটির হোম পেজে লেখা রয়েছে, ‘…this app helps keep you and your data safe when you go online, by blocking potentially harmful websites and securing your personal information.’



কিন্তু আসলে ওনাভো প্রোটেক্ট অ্যাপটি কী করত? যিনি এই অ্যাপটি ফোন বা আইপ্যাডে ইনস্টল করতেন, সেই ব্যক্তির আইডেন্টিটির পাশাপাশি তাঁর ওয়েব অ্যাক্টিভিটি সম্পর্কে নিয়মিত ফেসবুককে গোপনে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিত ওনাভো।


হোয়াটসঅ্যাপ রিপোর্ট


২০১৪ সালে ওনাভোর পাঠানো সেই গোপন রিপোর্ট দেখেই ফেসবুক জানতে পারে যে, যাঁদের ফোনে ফেসবুক মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ দুটোই রয়েছে, তাঁরা সারাদিনে মেসেঞ্জারের তুলনায় হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দ্বিগুন সংখ্যক মেসেজ পাঠান। রিপোর্ট দেখে ফেসবুক বুঝতে পেরেছিল তাদের মেসেঞ্জারের অ্যাপের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে হোয়াটসঅ্যাপ। সেক্ষেত্রে ব্যাবসা বাঁচাতে গেলে এমন কিছু করতে হবে যাতে হোয়াটসঅ্যাপ কোম্পানিটাই বন্ধ হয়ে যায়, কিংবা কিনে নিতে হবে হোয়াটসঅ্যাপকে। শেষ পর্যন্ত তারা দ্বিতীয় পদ্ধতিটাই নেয়। ১৯০০ কোটি ডলারের এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে ফেসবুক কিনে নেয় হোয়াটসঅ্যাপ কোম্পানিকে।


ফেসবুককে শো-কজ


ফ্রি ভিপিএন পরিষেবা দেওয়ার নাম করে ওনাভো অ্যাপের মাধ্যমে ফেসবুক যে সাধারণ মানুষের উপর এভাবে গোপন নজরদারি চালিয়ে তাদের পার্সোনাল ডেটা সংগ্রহ করছিল, তা সামনে আসে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে। গ্রাহকদের পার্সোনাল ডেটার সুরক্ষার বিষয়ে অ্যাপলের নীতি অত্যন্ত কঠোর। তাই ওনাভো অ্যাপের বিষয়টি সামনে আসার পরেই ফেসবুককে শো-কজ করে অ্যাপল, পাশাপাশি নিজেদের তথ্য সুরক্ষার নীতি (data protection policy) আরও কঠোর করে। শেষ পর্যন্ত অ্যাপলের নির্দেশ মেনে তাদের অ্যাপস্টোর থেকে গত বছরের আগস্টে অ্যাপটি সরিয়ে নেয় ফেসবুক। যদিও মজার ব্যাপার হল গুগলের প্লে স্টোরে ওনাভো প্রোটেক্ট অ্যাপটি এখনও রয়ে গেছে। অর্থাৎ অ্যাপটির মাধ্যমে অ্যান্ড্রয়েড গ্রাহকদের পার্সোনাল ডেটা এখনও হাতিয়ে নিচ্ছে ফেসবুক, কিন্তু গুগলের বিষয়টি নিয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই! 


পেছন থেকে নজরদারি


অ্যাপল তাদের অ্যাপ স্টোর থেকে ওনাভো প্রোটেক্ট অ্যাপটি সরিয়ে দেওয়ার পর মুশকিলে পড়ল ফেসবুক। কারণ সেক্ষেত্রে আইফোন ও আইপ্যাড ব্যবহারকারীদের উপর কীভাবে নজরদারি চালাবে তারা? ফেসবুক ঠিক করল নিজেদের সামনে না এনে অন্যদের সাহায্যে এমনভাবে নজরদারি চালাতে হবে যাতে অ্যাপল কিছু বুঝতে না পারে। 


ফেসবুক রিসার্চ


সেজন্য ফেসবুক একটি ভিপিএন অ্যাপ তৈরি করল যার নাম ফেসবুক রিসার্চ। ফেসবুক অ্যাপলকে জানাল যে, ফেসবুক রিসার্চ অ্যাপটি তারা অ্যাপলের অ্যাপস্টোরে লঞ্চ করবে ডেভেলপার এন্টারপ্রাইজ প্রোগ্রামের জন্য। 


ডেভেলপার এন্টারপ্রাইজ প্রোগ্রাম


ডেভেলপার এন্টারপ্রাইজ প্রোগ্রাম কাকে বলে? ধরা যাক ‘A’ একটি অ্যাপ ডেভেলপার কোম্পানি। ‘A’ একটি অ্যাপ তৈরি করেছে। এবার কোম্পানি ঠিক করল তারা তাদের নতুন অ্যাপটি অফিশিয়ালি লঞ্চ করার আগে কোম্পানির কর্মীদের দিয়ে টেস্ট করিয়ে দেখবে ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা। সেজন্য ‘A’ কোম্পানি তাদের অ্যাপটিকে অ্যাপলের অ্যাপস্টোরে লঞ্চ করল এবং নিজেদের কর্মীদের বলল সেখান থেকে অ্যাপটি ডাউনলোড করে ব্যবহার করতে। এইভাবে কোনও ডেভেলপার কোম্পানি যখন তাদের তৈরি অ্যাপটিকে অ্যাপলের অ্যাপস্টোরে লঞ্চ করে নিজেদের কর্মীদের দিয়ে টেস্ট করায় তখন সেই প্রক্রিয়াটিকে বলা অ্যাপল ডেভেলপার এন্টারপ্রাইজ প্রোগ্রাম। কিন্তু এজন্য সেই ডেভেলপার (এক্ষেত্রে ‘A’) কোম্পানিকে অ্যাপলের কাছ থেকে ‘এন্টারপ্রাইজ সার্টিফিকেট’ নিতে হয়। অ্যাপল কোম্পানির নিয়ম হল, যদি কোনও কোম্পানি ‘ডেভেলপার এন্টারপ্রাইজ প্রোগ্রাম’-এ অংশ নিয়েও নিজের কোম্পানির কর্মীদের বদলে সাধারণ মানুষকে সেই অ্যাপটি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করে, তবে সেই কোম্পানির ‘এন্টারপ্রাইজ সার্টিফিকেট’ ক্যানসেল করা হবে। 


গোপন চুক্তি


ফেসবুক তাদের নতুন ভিপিএন অ্যাপ ফেসবুক রিসার্চ ‘ডেভেলপার এন্টারপ্রাইজ প্রোগ্রাম’-এর অধীনে অ্যাপলের অ্যাপস্টোরে লঞ্চ করল ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি তারা গোপনে তিনটি বিটা টেস্টিং সার্ভিস কোম্পানির সঙ্গেও চুক্তি করল। 


বিটা টেস্টিং সার্ভিস


Image credit: uTest


বিটা টেস্টিং সার্ভিস কোম্পানিগুলির নিজস্ব অ্যাপ থাকে। সেই অ্যাপের মাধ্যমে তারা গ্রাহকদের টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন অনলাইন সমীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য বা তাদের পার্সোনাল ডেটা কোম্পানির সঙ্গে শেয়ার করার জন্য উৎসাহিত করে। ফেসবুক যে তিনটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করল তাদের অ্যাপগুলি হল অ্যাপ্লজ (Applause) , বিটাবাউন্ড (BetaBound) এবং ইউটেস্ট (uTest)।


২০ ডলারে তথ্য বিক্রি


এবার ফেসবুক করল কী, যাঁরা ফোনে বা আইপ্যাডে অ্যাপ্লজ, বিটাবাউন্ড বা ইউটেস্ট -  এর মধ্যে কোনও একটি অ্যাপ ব্যবহার করেন, তাঁদের সেই অ্যাপগুলির মাধ্যমে নিয়মিত মেসেজ পাঠাত শুরু করল। মেসেজটি ছিল এরকম যে - আপনারা অ্যাপস্টোর থেকে ফেসবুক রিসার্চ অ্যাপটি ডাউনলোড করে ইনস্টল করুন এবং সেজন্য আপনারা প্রতিমাসে ২০ ডলারের গিফট কুপন পাবেন। এই মেসেজটি পাঠাত ওই তিনটি অ্যাপ। 



ফেসবুক যে আসলে পেছনে থেকে মেসেজটি পাঠাচ্ছে তা কোথাও লেখা থাকত না। মেসেজটি পেয়ে মাসে ২০ ডলার (প্রায় দেড় হাজার টাকা)-এর লোভে বহু লোক অ্যাপস্টোর থেকে ফেসবুক রিসার্চ ভিপিএন অ্যাপটি ডাউনলোড করে ফোনে ইনস্টল করে। আর এর ফলে ফেসবুক রিসার্চ অ্যাপটির মাধ্যমে ফেসবুক ফের সাধারণ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের উপর গোপনে নজরদারি চালাতে শুরু করে। এইভাবে ফেসবুক সাধারণ মানুষের তথ্য হাতানোর জন্য অ্যাপলের ডেভেলপার এন্টারপ্রাইজ প্রোগ্রামের নিয়ম নীতি পুরোপুরি লঙ্ঘন করেছিল। 


ধরা পড়ে মুচলেকা


অবশেষে, মাত্র চারদিন আগে ফেসবুকের এই কীর্তি সামনে আসে। ঘটনাটি সামনে আসার পরদিনই অ্যাপল ফেসবুকের এন্টারপ্রাইজ সার্টিফিকেট ক্যানসেল করে দেয় এবং অ্যাপস্টোর থেকে ফেসবুক রিসার্চ ভিপিএন অ্যাপটি সরিয়ে দেয়। গতকাল ফেসবুক অ্যাপলের কাছে মুচলেকা দেয় যে, তারা আর কখনো ডেভেলপার এন্টারপ্রাইজ প্রোগ্রামের নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করবে না। তারপর ফের ফেসবুকের নামে নতুন করে এন্টারপ্রাইজ সার্টিফিকেট ইশু করে অ্যাপল। তবে ফেসবুক রিসার্চ অ্যাপটিকে তারা আর অ্যাপস্টোরে ফিরিয়ে আনেনি, আনবেও না। 



টেকনোবিটসের এই ব্লগটি পড়ে যদি ভালো লাগে তবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করুন। কমেন্ট করুন ব্লগের নীচে বা টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে।


টেকনোবিটসের ব্লগগুলি যদি নিজের ফেসবুক নিউজ ফিডে পেতে চান, তবে টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে গিয়ে Follow বাটন ক্লিক করে তারপর See first অপশনটিতে ক্লিক করুন। ইমেল সাবস্ক্রিপশনের  জন্য টেকনোবিটসের ব্লগ সাইটে নিজের ইমেল আইডি সাবমিট করে রেজিস্ট্রেশন করুন। ধন্য়বাদ। 


2 comments:

  1. সাংঘাতিক ব্যাপার ।

    ReplyDelete
  2. FB এর কাজই হলো চুরি-চামারি করে পেট চালানো.... আর কি বা পারে এরা। বারবার ধরা পড়ে, আর বারবার নতুন কায়দায় চুরি করতে নামে।
    "গ্লোবাল চোর" নামটাই মনে হয় বেশি suitable. 😃😃😃

    ReplyDelete

জনপ্রিয় পোস্ট