27 Jul 2018

অ্যান্ড্রয়েডের ভবিষ্যৎ কি সংকটে?

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অপারেটিং সিস্টেম কোনটি?
Image Credit : Pixabay
উত্তরটা দেওয়ার জন্য কম্পিউটার বা মোবাইল বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। কারণ সবাই জানে যে উত্তরটা হল অ্যান্ড্রয়েড। বর্তমানে বিশ্বে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের মার্কেট শেয়ার ৪১.৭%। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে উইনডোজ অপারেটিং সিস্টেম যার মার্কেট শেয়ার ৩৬.১৯%। এই হিসেব চলতি বছরের জুন মাসের (তথ্য সূত্র : gs.statcounter.com)। কিন্তু অ্যান্ড্রয়েড বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অপারেটিং সিস্টেম হওয়া সত্ত্বেও এখন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্ন ওঠার কারণ সম্প্রতি ইউরোপিয়ান কমিশনের একটি রায়। যে রায়ে অ্যান্ড্রয়েড নির্মাতা গুগলকে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার জরিমানা করা হয়েছে। 



ব্যবসার পদ্ধতি পালটাতে হবে

জরিমানার অংকটা বড় কথা নয়, কারণ চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত যে হিসেব তাতে গুগলের কাছে এখন নগদ ১০,৩০০ কোটি টাকা রয়েছে। সুতরাং জরিমানা দিতে গুগলের সমস্যা হবে না। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। সেটা হল ইউরোপিয়ান কমিশন গুগলকে নির্দেশে দিয়েছে, জরিমানা দেওয়ার পাশাপাশি ৯০ দিনের মধ্যে অ্যান্ড্রয়েড সংক্রান্ত ব্যবসার পদ্ধতি পালটাতে হবে। যদি গুগল তা না করে, তবে গুগল প্রতিদিন বিশ্বে যত টাকার ব্যাবসা করে তার ৫% জরিমানা হিসেবে দিতে হবে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে ইউরোপিয়ান কমিশন। আর তার জেরেই অ্যান্ড্রয়েডের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।




অ্যান্ড্রয়েড ইকো সিস্টেম

গুগলের অ্যান্ড্রয়েড ব্যবসার পদ্ধতি জানতে হলে প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে অ্যান্ড্রয়েড ইকো সিস্টেম কাকে বলে। ইকো সিস্টেম অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে আমরা স্কুলে সবাই জীবন বিজ্ঞানের বইতে পড়েছি। প্রকৃতির ইকো সিস্টেম হল এমন এক সিস্টেম যার সদস্য প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ অর্থাৎ অ্যামিবা থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত সবাই। তারা এই সিস্টেমে পরস্পরের সঙ্গে খাদ্য-খাদক সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছে। যেমন, জলজ উদ্ভিদ ও পোকামাকড় খেয়ে বাঁচে মাছ, আবার মানুষ সেই মাছ খায়।

অ্যান্ড্রয়েড ইকো সিস্টেমও হল এমন একট সিস্টেম যার সদস্য বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানি যারা অ্যান্ড্রয়েড ফোন বিক্রি করে, বিভিন্ন অ্যাপ কোম্পানি বা অ্যাপ ডেভেলপার (গুগল প্লে স্টোরে যে অ্যাপগুলি পাওয়া যায় সেই সমস্ত অ্যাপ যে কোম্পানিগুলি বা ব্যক্তিরা তৈরি করেছে তারা) এবং অ্যান্ড্রয়েড ফোন যারা ব্যবহার করে সেই সমস্ত সাধারণ মানুষ। এই সিস্টেমে প্রত্যেকে সদস্য (মোবাইল কোম্পানি, অ্যাপ ডেভেলপার ও উইজার অর্থাৎ ফোন ব্যবহারকারীরা) নিজেদের স্বার্থে প্রত্যেকের উপর নির্ভরশীল। আর এর জেরেই গুগল অন্য কোম্পানিগুলিকে পেছনে ফেলে হাজার হাজার কোটি টাকা উপার্জন করছে। তাই ইউরোপিয়ান কমিশন গুগলের এই অ্যান্ড্রয়েড ইকো সিস্টেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। 

অ্যান্ড্রয়েড ইকো সিস্টেম যেভাবে কাজ করে

অ্যান্ড্রয়েড ওএস একটি ফ্রিওয়্যার। তাই বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সমস্ত মোবাইল ফোন কোম্পানি তাদের ফোনে অ্যান্ড্রয়েড ওএস ব্যবহার করে, কারণ এই ওএস ব্যবহার করার জন্য গুগলকে কোনও টাকা দিতে হয় না। ফলে কোম্পানিগুলির ফোন তৈরির খরচ অনেকটাই কমে যায়। তাই কোম্পানিগুলি ক্রেতাকে কম টাকায় ফোনটি বিক্রি করতে পারে। দাম কম থাকায় একদিকে কোম্পানির ফোন বিক্রি বাড়ে, অন্যদিকে ক্রেতাও কম দামে ফোনটি পেয়ে খুশি হয়। ফলে কোম্পানি ও ক্রেতা দুই পক্ষেরই স্বার্থ পূরণ হয়। 

কিন্তু অ্যান্ড্রয়েড ওএস ফ্রিতে ব্যবহার করার জন্য মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলিকে গুগলের নির্দেশ মেনে চলতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ হল অ্যান্ড্রয়েড ফোনে গুগলের নিজস্ব কিছু প্রিইনস্টলড অ্যাপ রাখতে হবে। যেমন, গুগল সার্চ ইঞ্জিন, ক্রোম ব্রাউজার, প্লে স্টোর ইত্যাদি। এটা হল ইকো সিস্টেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ, গুগলের এই নিয়মের জেরে যে ব্যক্তি অ্যান্ড্রয়েড ফোনটি কিনছে সে সাধারণত ক্রোম ব্রাউজার ও গুগল সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে ইন্টারনেট সার্চ করবে এবং তাকে গুগল প্লে স্টোর থেকেই মূলত অ্যাপ ডাউনলোড করে ব্যবহার করতে হবে। সেই ব্যক্তি ক্রোম ব্রাউজার ও গুগল সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে যত বেশি ইন্টারনেট সার্চ করবে বা প্লে স্টোর থেকে যত বেশি অ্যাপ ডাউনলোড করবে, গুগল তত বেশি রোজগার করবে। 

ইকো সিস্টেমের অন্যতম সদস্য অ্যাপ ডেভেলপাররা। অ্যান্ড্রয়েড ওএস ফ্রি তাই বিশ্বের প্রায় সমস্ত মোবাইল ফোন কোম্পানি তাদের ফোনে এই ওএস ব্যবহার করে। ফলে নিজেদের তৈরি অ্যাপ যাতে বেশি লোকের কাছে পৌঁছায় সেজন্য অ্যাপ ডেভেলপাররাও মূলত অ্যান্ড্রেয়ড ফোনের জন্য অ্যাপ তৈরি করে সেটিকে গুগল প্লে স্টোরে রেজিস্ট্রেশন করে। অর্থাৎ অ্যাপ ডেভেলপারদেরও তাদের ব্যবসায়ীক স্বার্থের জন্য অ্যান্ড্রয়েড ইকো সিস্টেমেই ঢুকতে হচ্ছে। আর এই গোটা প্রক্রিয়ার জেরে লাভবান হচ্ছে গুগল। কারণ প্লে স্টোর যত নতুন নতুন অ্যাপ রেজিস্ট্রেশন হবে, সেখান থেকে যত বেশি অ্যাপ ডাউনলোড হবে, গুগলের তত রোজগার বাড়বে। প্রকৃতির ইকো সিস্টেমে যেমন সবার উপরে রয়েছে মানুষ, তেমনি অ্যান্ড্রয়েড ইকো সিস্টেমে একদম উপরে রয়েছে গুগল কোম্পানি, যে এই ইকো সিস্টেম থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে অর্থাৎ মুনাফা অর্জন করছে।    

কমিশনের পর্যবেক্ষণ

২০১৫ সালের এপ্রিলে ফেয়ারসার্চ নামে একটি গ্রুপ (যে গ্রুপের সদস্য মাইক্রোসফট, নোকিয়া, ওরাকল সহ একাধিক বড় বড় টেক কোম্পানি) গুগলের বিরুদ্ধে ‘অন্যায়’ ভাবে ব্যাবসা করার অভিযোগ করেছিল  ইউরোপিয়ান কমিশনের কাছে। সেই অভিযোগ সঠিক বলে মেনে নিয়েছে কমিশন। কমিশন বলেছে, অ্যান্ড্রয়েড ইকো সিস্টেমের জেরে গুগল ব্যবসার ক্ষেত্রে অন্যায় সুবিধা ভোগ করছে। বিশ্বে বিভিন্ন কোম্পানির নিজস্ব সার্চ ব্রাউজার এবং অ্যাপ স্টোর রয়েছে যেগুলির কোয়ালিটি যথেষ্ট ভালো। কিন্তু গুগলের দাপটে সেগুলি সেভাবে প্রচারে আসছে না অর্থাৎ ভালো ব্যাবসা করতে পারছে না। কারণ অ্যান্ড্রয়েড ফোনে বাই ডিফল্ট ক্রোম ব্রাউজার, গুগল সার্চ ইঞ্জিন এবং প্লে স্টোর ইনস্টল করা থাকছে। তাই অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীরা মূলত সেগুলি ব্যবহার করে আর তার জেরে অন্য কোম্পানিগুলির ব্যাবসা মার খাচ্ছে। ইউরোপিয়ান কমিশন তাই গুগলকে তাদের এই ব্যাবসার পদ্ধতি পালটাতে বলেছে। 

ইউরোপিয়ান কমিশন অবশ্য একা নয়, এর আগে গুগলকে একই রকম নির্দেশ দিয়েছে রাশিয়ার আদালত এবং গুগল সেটা মানতে বাধ্য হয়েছে। রাশিয়ার অন্যতম বড় সার্চ ইঞ্জিন হল Yandex এবং Mail.ru। সে দেশের আদালতের নির্দেশে ২০১৭ সালের জুন থেকে রাশিয়ায় অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলিতে গুগল সার্চ ইঞ্জিনের বদলে ক্রেতাকে Yandex বা Mail.ru কে ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এর জেরে রাশিয়ার ওই দুটি সার্চ ইঞ্জিন এখন যথেষ্ট ভালো ব্যাবসা করছে। গত একবছরে Yandex সার্চ ইঞ্জিনের ব্যাবসা ৩৪% থেকে বেড়ে ৪৬% হয়েছে।

গুগলের দাবি

স্বাভাবিক ভাবেই গুগল ইউরোপিয়ান কমিশনের এই রায়ের সঙ্গে সহমত হয়নি। কমিশনের এই রায়ের পর গুগল জানিয়েছে, তারা মোটেই অন্যায় ভাবে ব্যাবসা করছে না। বরং তারা হিসেব করে দেখিয়েছে যে, অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ গুগলের ক্রোম ব্রাউজার ছাড়া অন্য ব্রাউজারও ব্যবহার করে। 

গুগলের দাবি অনুসারে, একজন অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারী গড়ে তার মোবাইল ফোনে ৫০টি অ্যাপ ডাউনলোড করে। গত এক বছরে বিশ্বে অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীরা প্লে স্টোর থেকে ৯৪০০ কোটি বার বিভিন্ন অ্যাপ ডাউনলোড করেছে। তার মধ্যে প্লে স্টোর থেকে ১০ কোটি বার ডাউনলোড করেছে অপেরা মিনি এবং ফায়ারফক্স ব্রাউজার অ্যাপ। এছাড়া ইউসি ব্রাউজার ডাউনলোড করেছে ৫০ কোটি বার। তাই গুগলের দাবি, অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীদের বিকল্প ব্রাউজার ব্যবহার করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

আগামীতে কী হতে পারে

স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপিয়ান কমিশনের এই রায়ের বিরুদ্ধে গুগল ফের মামলা করবে। তাদের টাকার অভাব নেই, তাই বিশ্বের সেরা আইনজীবীদের তারা সেই মামলা লড়ার জন্য নিয়োগ করবে। কিন্তু যদি শেষ পর্যন্ত সেই মামলাতেও গুগল হেরে যায়? সেই প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ আমেরিকার কোম্পানিগুলিকে ইউরোপে মোটেই ভালো চোখে দেখা হয় না। তাই নতুন করে মামলা লড়লেও তাতে গুগলের হেরে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তাই গুগলের চিফ এক্সিকিউটিভ সুন্দর পিচাই ইউরোপিয়ান কমিশনের এই রায়ের পর ইঙ্গিত দিয়েছেন, আগামী দিনে অ্যান্ড্রয়েডের ব্যবসায়ীক নীতিতে বড় মাপের পরিবর্তন হতে পারে। অর্থাৎ অ্যান্ড্রয়েড ইকো সিস্টেম এখন যে পদ্ধতিতে কাজ করছে, তা পালটে যেতে পারে। সম্ভবত আগামী দিনে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম আর ফ্রি-তে ব্যবহার করতে পারবে না মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলি। 

কয়েক বছর আগে মাইক্রোসফট তৈরি করেছিল তাদের উইনডোজ মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম। এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম রয়েছে সেগুলির মধ্যে মাইক্রোসফটের উইনডোজ ও অ্যাপলের আইওএস কিন্তু অ্যান্ড্রয়েডের থেকে অনেক বেশি সিকিউর এবং পাওয়ারফুল। কিন্তু মাইক্রোসফট তাদের মোবাইল উইনডোজ অপারেটিং সিস্টেম ফ্রি করেনি। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলিকে তাদের ফোনে সেটি ব্যবহার করার জন্য মাইক্রোসফটকে টাকা দিতে হত। তাই বেশিরভাগ কোম্পানি সেটি ব্যবহার না করে অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করত। ফলে উইনডোজ মোবাইল সেভাবে চলেনি। কিন্তু আগামীতে অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করার জন্য যদি মোবাইল কোম্পানিগুলিকে টাকা দিতে হয়, সেক্ষেত্রে অ্যান্ড্রয়েডের সঙ্গে অন্য মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের সমানে সমানে প্রতিযোগিতা হবে। তখন আর অ্যান্ড্রয়েড বাড়তি সুবিধা পাবে না। তখন কি মোবাইল ফোন কোম্পানগুলি এখনকার মতো শুধু অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করবে? নাকি উইনডোজ, আমাজনের ফায়ার ওএস কিংবা অন্য কোনও ওএস-এর দিকে ঝুঁকবে? তাহলে তখন অ্যান্ড্রয়েড কি আজকের মতো এমন জনপ্রিয় থাকবে? এই প্রশ্নগুলি ইতিমধ্যে উঠতে শুরু করেছ। সব মিলিয়ে অ্যান্ড্রয়েড এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।


টেকনোবিটসের এই ব্লগটি পড়ে যদি ভালো লাগে তবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করুন। কমেন্ট করুন ব্লগের নীচে বা টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে।


টেকনোবিটসের ব্লগগুলি যদি নিজের ফেসবুক নিউজ ফিডে পেতে চান, তবে টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে গিয়ে Follow বাটন ক্লিক করে তারপর See first অপশনটিতে ক্লিক করুন। ইমেল সাবস্ক্রিপশনের  জন্য টেকনোবিটসের ব্লগ সাইটে নিজের ইমেল আইডি সাবমিট করে রেজিস্ট্রেশন করুন।




1 comment:

জনপ্রিয় পোস্ট