8 Mar 2019

শিয়াওমির ফোন আর সস্তা নয়


Image Credit: Xiaomi 

চিনের শিয়াওমি ফোনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল দাম। তারা বাজারের অন্য কোম্পানিগুলির তুলনায় অনেক সস্তায় লেটেস্ট স্পেসিফিকেশনের ফোন বিক্রি করে। তাই ২০১১ সালে স্মার্ট ফোন বিক্রি শুরুর পর মাত্র ৮ বছরে চিন ও ভারতে এই কোম্পানি এখন এক নম্বরে। অর্থাৎ এই দুই দেশে শিয়াওমির ফোন সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এছাড়া এশিয়ার আরও অনেক দেশে শিয়াওমি ফোনের বিক্রি যথেষ্ট বেশি। কিন্তু গতকাল কোম্পানির সিইও লেই জান জানিয়েছেন, শিয়াওমি চলতি বছর থেকেই তাদের ফোনের দাম কিছুটা বাড়াবে। ফলে শিয়াওমির ফোন এখন যতটা সস্তায় পাওয়া যায়, আগামীতে ততটা সস্তা আর থাকছে না।



শিয়াওমি কেন তাদের ফোনের দাম বাড়াবে, সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে টেকনোবিটসের পাঠকদের বলে নেই, কেন বাজারের অন্য বড়  কোম্পানিগুলির তুলনায় শিয়াওমি ফোনের দাম এতটা কম।


শিয়াওমির বিজনেস মডেল পাঁচটি মূল কৌশল বা নীতির উপর দাঁড়িয়ে। সেগুলি আমি নীচে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি



নকলনবীশ


অ্যাপল, স্যামসাঙ, পিক্সল, মোটরলা, আসুস, এলজি ইত্যাদি ফোন কোম্পানিগুলির আর অ্যান্ড ডি বিভাগ (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) রয়েছে। ফোনে ব্যবহৃত প্রযুক্তির অর্থাৎ সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারকে কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সেই বিষয়ে কোম্পানির আর অ্যান্ড ডি বিভাগের ইঞ্জিনিয়াররা কাজ করেন। আর অ্যান্ড ডি বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের যেমন প্রচুর বেতন দিতে হয়, তেমনি এই বিভাগটি চালানোর অন্যান্য খরচও অনেক। কোম্পানি যখন নতুন কোনও ফোন লঞ্চ করে, তখন তার দাম এমন রাখা হয় যাতে আর অ্যান্ড ডি বিভাগের পেছনে কোম্পানি যে মোটা টাকা খরচ করছে সেই টাকাও যেন ফোন বিক্রি থেকে উঠে আসে। 




কিন্তু শিয়াওমি কোম্পানির সেই অর্থে কোনও আর অ্যান্ড ডি বিভাগ নেই। অ্যাপল, স্যামসাঙ ইত্যাদি কোম্পানির আর অ্যান্ড ডি বিভাগ যে সমস্ত নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে, শিয়াওমি সেগুলি নকল করে নিজেদের ফোনে ব্যবহার করে। যেহেতু রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জন্য টাকা খরচ করতে হয় না, তাই শিয়াওমি কোম্পানির ফোনের দাম বাজারের অন্যান্য বড় ব্র্যান্ডের ফোনের থেকে কম।


অনলাইন মার্কেটিং 


যখন কোম্পানি বাজারে কোনও ফোন লঞ্চ করে, তখন ফোনটির সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার তৈরির খরচের সঙ্গে আর অ্যান্ড ডি বিভাগ চালানোর খরচ, বিজ্ঞাপন ও মার্কেটিং সংক্রান্ত খরচ ইত্যাদি যোগ করে এবং কোম্পানি কতটা লাভ রাখবে সেটা ধরে তারপর ফোনটির দাম ঠিক করা হয়।

আগেই বলেছি শিয়াওমির আর অ্যান্ড ডি সংক্রান্ত তেমন কোনও খরচ নেই। পাশাপাশি মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রেও শিয়াওমি প্রথম থেকেই অফলাইনের বদলে অনলাইনে জোর দিয়েছে। শিয়াওমির আগে অন্যান্য ফোন কোম্পানি অফলাইন মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে মূলত ফোন বিক্রি করত। অর্থাৎ, কোম্পানিগুলি দেশের বড় বড় শহরে শোরুম খুলে এবং ছোটো শহরগুলিতে খুচরো ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ফোন বিক্রি করত। শোরুম খোলা এবং সেখানে কর্মীদের বেতন দিয়ে রেখে ফোন বিক্রির খরচ বেশি। এছাড়া খুচরো ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ফোন বিক্রি করতে হলে তাঁদেরকেও লাভের একটা বড় অংশ কমিশন হিসেবে কোম্পানিকে দিতে হয়। শিয়াওমি তাই প্রথম থেকে অফলাইনের বদলে অনলাইন মার্কেটিংয়ে জোর দিয়েছে। তারা মূলত অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, আলিবাবা বা নিজেদের অনলাইন স্টোরের মাধ্যমে ফোন বিক্রি করে। এর ফলে শোরুম খোলার খরচ নেই, খুচরো ব্যবসায়ীদেরও মোটা টাকা কমিশন দিতে হচ্ছে না। অনলাইন স্টোরগুলির মাধ্যমে যেহেতু একসঙ্গে অনেক ফোন বিক্রি করা সম্ভব, তাই স্টোরগুলিও খুচরো ব্যবসায়ীদের থেকে অনেক কম কমিশন নেয়। ফলে ফোনের দাম কম রেখেও শিয়াওমি যথেষ্ট লাভ করে। শিয়াওমির অনলাইন মার্কেটিং নীতি এখন অবশ্য অন্যান্য কোম্পানিও অনুসরণ করছে।


বিজ্ঞাপন


টিভি, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন দিতেও ফোন কোম্পানিগুলি প্রচুর টাকা খরচ করে। সেই টাকাও ফোনের দামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়, ফলে ফোনের দাম বেশি পড়ে। তাই বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিশেষ কৌশল নিয়েছে শিয়াওমি। তারা সাধারণত অন্য কোম্পানিগুলির মতো টিভি, সংবাদপত্র ইত্যাদিতে প্রচুর টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দেয় না। ফোনের প্রচারের জন্য তারা মূলত ফেসবুক বা ওই ধরনের সোশাল মিডিয়া এবং সাধারণ ক্রেতাদের উপর ভরসা করে। 

যেমন, ২০১৬ সালে Redmi Note 3 ফোন লঞ্চের আগে তার বিজ্ঞাপনের জন্য শিয়াওমি সাধারণ ক্রেতা বা ‘Mi Fan’ দের ব্যবহার করেছিল। শিয়াওমির যে নিজস্ব পেজ রয়েছে, সেই পেজের সদস্যদের বলা হয় Mi Fan। যে কেউ এই পেজের সদস্য হতে পারেন। Redmi Note 3 লঞ্চ হয়েছিল মার্চে। তার আগে শিয়াওমি দেখে নিয়েছিল তাদের পেজে সবচেয়ে অ্যাকটিভ মেম্বার কারা। পেজের সবচেয়ে অ্যাকটিভ প্রথম ১০০ জন মেম্বার বা Mi Fan – কে শিয়াওমি ফেব্রুয়ারি মাসে Redmi Note 3 ফোনটি দিয়েছিল টেস্ট করে মতামত জানাতে। মেম্বারদের বলা হয়েছিল তারা যেন ফেসবুক, শিয়াওমির পেজে এবং অন্যান্য সোশাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মে মতামত জানায়। পরে দেখা যায়, সোশাল মিডিয়ায় সেই ১০০ জন মেম্বার ফোনটি নিয়ে যে মতামত দিয়েছিল, তা আকৃষ্ট করেছিল তিন লাখ লোককে। অর্থাৎ কোনও টাকা খরচ না করেই তিন লাখ লোকের মধ্যে শিয়াওমি তাদের ফোনের প্রচার করতে পেরেছিল।


অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং


অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় শিয়াওমি খুব বেশি লাভ রেখে ফোন বিক্রি করে না। তাই তাদের ফোনের দাম অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় কম। যদি ধরি স্যামসাঙ একটি ফোন বিক্রি করার সময় ক্রেতার কাছ থেকে ১০ টাকা লাভ রাখে, তবে শিয়াওমি রাখে ৫ থেকে ৬ টাকা। কিন্তু আখেরে তাতে শিয়াওমির কোনও ক্ষতি হয় না। কারণ তারা ক্রেতাদের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে (অর্থাৎ ক্রেতা যতদিন শিয়াওমির ফোনটি ব্যবহার করছেন) যে লাভ করে, সেটা স্যামসাঙের ১০ টাকা লাভের থেকে বেশি।

কীভাবে শিয়াওমি দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে ক্রেতার কাছ থেকে লাভ করে? ব্যাবসার এই নীতিকে বলে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং। শিয়াওমির সঙ্গে অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, জ্যাবং, মাইন্ত্রা সহ একাধিক অনলাইন স্টোরের চুক্তি রয়েছে। চুক্তি অনুসারে শিয়াওমি ফোন ব্যবহার করে আপনি যখন ওই সমস্ত অনলাইন স্টোর থেকে কেনাকাটা করবেন, তখন প্রতিটি কেনাকাটার উপর বিশেষ কমিশন পায় শিয়াওমি। অনলাইন স্টোরগুলি শিয়াওমিকে এই কমিশন দেয়। এইভাবে শিয়াওমি ক্রেতাকে ফোন বিক্রি করার পরেও দীর্ঘদিন ধরে সেই ক্রেতার মাধ্যমে লাভ করে। 


কৃত্রিম অভাব


বাজারে কোনও পণ্যের যদি অভাব দেখা দেয়, তাহলে সেটা অনেক সময় সেই পণ্যের বিজ্ঞাপনী প্রচার হিসেবে কাজ করে। শিয়াওমি তাদের ব্যবসায় এই নীতি অনুসরণ করে। তারা কখনোই একসঙ্গে অনেক হ্যান্ডসেট তৈরি করে না। অনলাইন স্টোরে কোনও ফোন লঞ্চ করার আগে তারা ক্রেতাদের রেজিস্ট্রেশন করতে বলে। যদি শিয়াওমি দেখে যে, এক লাখ সম্ভাব্য ক্রেতা ফোনটি কেনার জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করেছেন, তবে তারা হয়তো ৫০ কি ৬০ লাখ সেট লঞ্চ করে। সেক্ষেত্রে অনলাইনে লঞ্চ করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফোনটির সবগুলি সেট বিক্রি হয়ে যায়। আর সেই খবরটা যখন সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়, তখন আরও অনেক লোক সেই ফোনটি সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠেন বা ফোনটি কিনবেন বলে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন।


সস্তার ফোন !


শিয়াওমির ফোনগুলির যেহেতু দাম কম হয়, তাই সেগুলির ক্রেতা মূলত মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তরা। সমাজের উচ্চবিত্ত ক্রেতাদের কাছে এখনও প্রথম পছন্দ স্যামসাঙের গ্যালাক্সি সিরিজের হাই-এন্ড ফোন, বা গুগল পিক্সল বা অ্যাপলের আইফোন। শিয়াওমির ফোনগুলির স্পেসিফিকেশন ভালো হলেও উচ্চবিত্ত ক্রেতাদের কাছে সেগুলি ‘সস্তার মাল’। 




এবার সমস্যা হল, বিশ্বজুড়ে গত কয়েক বছর ধরে স্মার্ট ফোনের বিক্রি ক্রমশ কমছে। কারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ক্রেতারা সাধারণত একটি ফোন কিনলে তা অন্তত ৩-৪ বছর বা তার বেশি ব্যবহার করেন। একমাত্র উচ্চবিত্ত ক্রেতারাই ১-২ বছর পরপর নতুন ফোন কেনেন। তাই শিয়াওমি সমস্যায় পড়েছে। কারণ তাদের ক্রেতাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। তাই এবার দাম বাড়িয়ে শিয়াওমি উচ্চবিত্ত ক্রেতাদের বাজার ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। কোম্পানির সিইও লেই জান জানিয়েছেন, Mi 9 সম্ভবত কোম্পানির শেষ হাই-এন্ড হ্যান্ডসেট যার দাম ৩০০০ ইউয়ান বা ৩১০০০ টাকার মধ্যে ছিল। আগামীতে শিয়াওমি যে সেটগুলি লঞ্চ করবে সেগুলির দাম ৩০০০ ইউয়ানের বেশি হবে। দেখা যাক, শিয়াওমি এভাবে উচ্চবিত্ত ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে ফোনের বিক্রি বাড়াতে পারে কিনা।

   

টেকনোবিটসের এই ব্লগটি পড়ে যদি ভালো লাগে তবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করুন। কমেন্ট করুন ব্লগের নীচে বা টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে।


টেকনোবিটসের ব্লগগুলি যদি নিজের ফেসবুক নিউজ ফিডে পেতে চান, তবে টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে গিয়ে Follow বাটন ক্লিক করে তারপর See first অপশনটিতে ক্লিক করুন। ইমেল সাবস্ক্রিপশনের  জন্য টেকনোবিটসের ব্লগ সাইটে নিজের ইমেল আইডি সাবমিট করে রেজিস্ট্রেশন করুন। ধন্য়বাদ। 


3 comments:

  1. শিয়াওমি ফোনে সবচাইতে বিরক্তিকর বিষয় হল তারা প্রতিটি অ্যাপের মাধ্যমে প্রচুর অযাচিত বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে। তাই ফোনের দাম বাড়ালে তাদের এই বিষয়টাও দেখা উচিত।

    ReplyDelete
  2. Asus m2 pro ba redmi note 7 kunta kinbo?

    ReplyDelete

জনপ্রিয় পোস্ট