2 Nov 2018

আপনার স্ট্যাটাসে বিজ্ঞাপন দেবে হোয়াটসঅ্যাপ

Image Credit: Pixabay
শেষ পর্যন্ত মার্ক জুকেরবার্গের সিদ্ধান্তই মেনে নিতে হল জ্যান কওমকে। আগামী বছর থেকেই ফেসবুকের মতো হোয়াটসঅ্যাপেও দেখা যাবে বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন। ইতিমধ্যে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান অ্যাকটন কোম্পানি ছেড়েছেন। এখন জ্যান কওম কী করেন সেটাই দেখার।




শুরুটা ছিল অন্যরকম


হোয়াটসঅ্যাপের শুরুটা ছিল অন্যরকম। ইয়াহু কোম্পানিতে চাকরি করতেন জ্যান কওম এবং ব্রায়ান অ্যাকটন। সেখানে তারা দেখেছিলেন কীভাবে সাধারণ গ্রাহকদের অনলাইন অ্যাক্টিভিটি (অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি কী সার্চ করছেন, কোন পেজ ভিজিট করছেন, কোন সাইটে কতক্ষণ রয়েছেন, কী কী ভিডিয়ো দেখছেন, কী পড়ছেন ইত্যাদি)-র উপর নজরদারি চালিয়ে সেই সমস্ত তথ্য বা ডেটা বিভিন্ন কোম্পানিকে বিক্রি করা হয়। সেই সমস্ত ডেটার ভিত্তিতে কোম্পানিগুলি জেনে নেয় কোনও ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ এবং তার ভিত্তিতে তারা সেই ব্যক্তির মোবাইল ফোনে বা কম্পিউটারে বিজ্ঞাপন দেয়। এই ধরণের বিজ্ঞাপনকে বলা হয় টার্গেটেড অ্যাড। 



পেইড অ্যাপের সিদ্ধান্ত


এই বিষয়টি পছন্দ ছিল না জ্যান কওম ও ব্রায়ান অ্যাকটনের। তাঁদের একটা আদর্শ ছিল। তাঁরা মনে করতেন, টাকার জন্য এভাবে গ্রাহকদের অনলাইন অ্যাক্টিভিটির উপর নজরদারি চালানো অন্যায়। তাই তারা যখন হোয়াটসঅ্যাপ তৈরির চিন্তাভাবনা করলেন, তখন ঠিক করলেন, তারা তাঁদের অ্যাপে কোনও বিজ্ঞাপন অর্থাৎ টার্গেটেড অ্যাড দেখাবেন না। কিন্তু বিজ্ঞাপন না দেখালে অ্যাপ চালানোর খরচ কীভাবে উঠবে? তাঁরা ঠিক করলেন, হোয়াটসঅ্যাপ হবে একটি পেইড অ্যাপ। অর্থাৎ এই অ্যাপ ব্যবহারের জন্য তাঁরা গ্রাহকদের কাছ থেকে বার্ষিক ৯৯ সেন্ট বা প্রায় ৭৫ টাকা (বর্তমানে ডলারের দাম অনুসারে) ফি নেবেন। 

প্রথম দিকে হয়েওছিল তাই। আইফোনে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করার জন্য বার্ষিক ফি দিতে হত। অ্যান্ড্রয়েড ফোনে প্রথম বছর হোয়াটসঅ্যাপ ফ্রি ছিল, তার পরের বছর থেকে ফি দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়েছিল (যদিও ভারত, বাংলাদেশের গ্রাহকদের কাছ থেকে কখনোই ফি নেওয়া হয়নি)।   


বিগ টেকওভার


কিন্তু জ্যান কওম ও ব্রায়ান অ্যাকটনের এই আদর্শের দিন যে ফুরিয়ে এসেছে, সেটা তখনই বোঝা গিয়েছিল, যখন ২০১৪ টেকনোলজির দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় ঘটনাটা ঘটল। কী ছিল সেই ঘটনা?  সেটা ছিল ১৯০০ কোটি ডলারের (তখন ১ ডলার ছিল ৬৩ টাকার সমান)  টেকওভার। অর্থাৎ ওই টাকা দিয়ে ফেসবুক কিনে নিল হোয়াটস্‌অ্যাপকে। 


জুকেরবার্গের প্রতিশ্রুতি


ফেসবুক যখন হোয়াটস্‌অ্যাপকে টেকওভার করল, তখন মার্ক জুকেরবার্গ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, হোয়াটসঅ্যাপ কোম্পানিকে ফেসবুক কিনে নিলেও সেই কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের বিষয়ে বিষয়ে ফেসবুক নাক গলাবে না। হোয়াটসঅ্যাপ কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে জ্যান কওম ও ব্রায়ান অ্যাকটনের সিদ্ধান্তই হবে শেষ কথা। কিন্তু সেসব ছিল নেহাতই কথার কথা। কারণ ১৯০০ কোটি ডলার ফেসবুক তো এমনি এমনি খরচ করেনি, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে লাভ করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য, আর সেটা বিজ্ঞাপন ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়।  


ইউজার বেস


সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলির মধ্যে ফেসবুকের ইউজার বেস অর্থাৎ গ্রাহক সংখ্যা এখন বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। এই সংখ্যাটি ২৩০ কোটি। তারপরেই রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ যার ইউজার বেস এখন ১৫০ কোটি। এই ১৫০ কোটি গ্রাহকরা সারাদিনে হোয়াটসঅ্যাপে প্রায় ৫৫০০ কোটি মেসেজ, প্রায় ৪৫০ কোটি ফটো ও ১০০ কোটি ভিডিয়ো আদানপ্রদান করে। এই সংখ্যাগুলি থেকে বোঝা যায় হোয়াটসঅ্যাপের ইউজার বেস বা গ্রাহকরা কতটা অ্যাকটিভ। আর যে সোশাল মিডিয়ায় গ্রাহকরা যত অ্যাকটিভ, সেখানে বিজ্ঞাপন দিয়ে কোম্পানিগুলির তত লাভ। 


আপাতত স্ট্যাটাস বিজ্ঞাপন


গত বুধবার দিল্লিতে ছিলেন হোয়াটসঅ্যাপ কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্রিস ড্যানিয়েল। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ফেসবুক এবার থেকে ব্যবসায়ীক স্বার্থে হোয়াটসঅ্যাপে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করবে। আগামী বছর থেকেই শুরু হবে বিজ্ঞাপন। কিন্তু কীভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে ড্যানিয়েল জানিয়েছেন, আপাতত শুধুমাত্র হোয়াটসঅ্যাপ গ্রাহকদের স্ট্যাটাসে বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে।


হোয়াসটঅ্যাপের বিজনেস পলিসি


আপাতত হোয়াটস্অ্যাপের স্ট্যাটাসে শুধু বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। তবে আমার মনে হয়, ব্যবসায়ীক স্বার্থে ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে হোয়াটসঅ্যাপ জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ Line-এর বিজনেস পলিসিকে অনুসরণ করবে। 

Line  মেসেজিং অ্যাপটি তৈরি করেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্থা ন্যাভের (Naver) কর্পোরেশন। মজার ব্যাপার হল এই অ্যাপটি কিন্তু প্রথমে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়নি। ২০১১ সালে জাপানের তোহোকু এলাকায় বড়মাপের ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই সময় ন্যাভের কর্পোরেশন জাপানে তাদের কর্মীদের জন্য এই অ্যাপটি তৈরি করেছিল। সংস্থার কোনও কর্মী ভূমিকম্পে বিপদে পড়লে এই মেসেজিং অ্যাপের সাহায্যে নিজের অবস্থান জানিয়ে পরিচিতদের মেসেজ করে সাহায্য চাইতে পারত।


কিছুদিনের মধ্যে অ্যাপটি ন্যাভের কর্পোরেশনের জাপানের কর্মীদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন সংস্থার তরফে অ্যাপটি বাণিজ্যিকভাবে লঞ্চ করা হয়। অ্যাপটির বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা (এই অ্যাপের গ্রাহকরা মূলত জাপান, তাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও তাইওয়ানের বাসিন্দা) এখন ৭০ কোটির বেশি এবং বছরে ব্যবসা করে প্রায় ১০০ কোটি ডলার। 

Line মেসেজিং অ্যাপ কিন্তু শুধু বিজ্ঞাপন দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করে না। বিজ্ঞাপন দেখানোর পাশাপাশি তারা ইন-অ্যাপ সার্ভিস ও ইন-অ্যাপ পারচেজ-এর মাধ্যমেও প্রচুর মুনাফা করে।


ইন-অ্যাপ পরিষেবা


ইন-অ্যাপ পরিষেবা হল কোনও অ্যাপকে মূলত যে পরিষেবার জন্য তৈরি করা হয়েছে, সেই পরিষেবার পাশাপাশি গ্রাহকদের অন্য যে সমস্ত পরিষেবা দেওয়া হয়। যেমন, Line অ্যাপ মূলত মেজেস আদানপ্রদানের জন্য তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি এই অ্যাপের ইন-অ্যাপ পরিষেবার মধ্যে রয়েছে ট্যাক্সি বুকিং, ইনস্ট্যান্ট মানি ট্রান্সফার, অনলাইন শপিং ইত্যাদি। অর্থাৎ আমরা যেমন অনলাইনে উবার বা ওলা অ্যাপ ব্যবহার করে ট্যাক্সি বা ক্যাব বুক করি। তেমনি Line অ্যাপের মধ্যে অনলাইনে ক্যাব বুক করার অপশন রয়েছে। Line অ্যাপের গ্রাহকরা সেই অ্যাপের মাধ্যমেই অনলাইনে ক্যাব বুক করতে পারবেন, এজন্য তাদের আলাদা করে ওই ক্যাব সংস্থাগুলির অ্যাপ ফোনে ডাউনলোড করার দরকার নেই। প্রতিটি বুকিংয়ের জন্য Line অ্যাপ ক্যাব সংস্থাগুলির কাছ থেকে কমিশন পায়। একইভাবে Line অ্যাপের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের চুক্তি রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের গ্রাহকরা Line অ্যাপের সাহায্যে টাকা ট্রান্সফার করতে পারে এবং এজন্য Line অ্যাপ ব্যাঙ্কগুলির কাছ থেকে কমিশন পায় (হোয়াটসঅ্যাপ মানি এই পদ্ধতিরই নকল)। এছাড়া Line অ্যাপের সাহায্যে অনলাইন স্টোর থেকেও গ্রাহকরা শপিং করতে পারে। গ্রাহকরা Line অ্যাপের সাহায্যে কোনও সংস্থার থেকে অনলাইনে শপিং করলে ওই সংস্থা Line অ্যাপকে কমিশন দেয়। এছাড়া এই অ্যাপে রয়েছে প্রচুর ভালো ভালো ইমোজি যেগুলি আপনাকে টাকা দিয়ে কিনতে হবে।


ইন-অ্যাপ পারচেজ  


Line অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকরা একাধিক জনপ্রিয় ভিডিয়ো গেম খেলতে পারে। অর্থাৎ এই অ্যাপের মধ্যে ভিডিও গেম খেলারও অপশন রয়েছে। অধিকাংশ ভিডিয়ো গেমই ফ্রি। এবার ধরুন আপনি একটি যুদ্ধের গেম ডাউনলোড করলেন। গেমটি ফ্রি। কিন্তু গেমটির কয়েকটি লেভেল খেলার পর দেখলেন শত্রুপক্ষে যারা রয়েছে তাদের কাছে আপনার থেকেও আধুনিক অস্ত্র ও অনেক বেশি গুলি-গোলা রয়েছে। এবার গেমটি আপনাকে অপশন দেবে - আপনি কি শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য তাদের থেকেও বেশি ক্ষমতার অস্ত্র ও বেশি গুলি-গোলা পেতে চান? যদি চান, তাহলে সেক্ষেত্রে আপনাকে কিন্তু সেগুলির জন্য অনলাইনে পে করতে হবে। এটাকেই বলে ইন-অ্যাপ পারচেজ। অর্থাৎ ভিডিয়ো গেমটি ফ্রি, কিন্তু আপনি যদি গেমটি খেলার সময় আরও ভালো পরিষেবা বা সুবিধা চান (এক্ষেত্রে আপনি যদি আরও ভালো ভাবে খেলতে চান) তাহলে আপনাকে টাকা খরচ করতে হবে। Line অ্যাপে এমন অনেক গেমে ইন-অ্যাপ পারচেজ অপশন রয়েছে। এই ইন-অ্যাপ পারচেজের জন্য কমিশন পায় Line অ্যাপ।

এখনও পর্যন্ত বিশ্বে যত মেসেজিং অ্যাপ রয়েছে সেগুলির মধ্যে আমার মতে Line অ্যাপের বিজনেস পলিসি সবচেয়ে ভালো। তাই মনে হয় আগামী দিনে হোয়াটসঅ্যাপ বিজ্ঞাপন সহ অন্যান্য বিষয়ে Line অ্যাপের বিজনেস পলিসি অনুসরণ করবে। 



টেকনোবিটসের এই ব্লগটি পড়ে যদি ভালো লাগে তবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করুন। কমেন্ট করুন ব্লগের নীচে বা টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে।


টেকনোবিটসের ব্লগগুলি যদি নিজের ফেসবুক নিউজ ফিডে পেতে চান, তবে টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে গিয়ে Follow বাটন ক্লিক করে তারপর See first অপশনটিতে ক্লিক করুন। ইমেল সাবস্ক্রিপশনের  জন্য টেকনোবিটসের ব্লগ সাইটে নিজের ইমেল আইডি সাবমিট করে রেজিস্ট্রেশন করুন। ধন্য়বাদ। 


No comments:

Post a Comment

জনপ্রিয় পোস্ট