6 Oct 2018

বিশ্বের সবচেয়ে বড় হার্ডওয়্যার হ্যাকিং, ধরা পড়ল চিন

Image credit: Pixabay
চালের দানার চেয়েও ছোটো একটি চিপ। কিন্তু ছোটো হলেও অসম্ভব ক্ষমতা তার। গত কয়েকবছর ধরে এই চিপ আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় কোম্পানি, ব্যাঙ্ক, সরকারি দপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার সার্ভার থেকে যাবতীয় তথ্য চুরি করছে। বিষয়টি সামনে আসায় হতবাক সবাই। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের ইতিহাসে এর আগে এত বড়মাপের হার্ডওয়্যার হ্যাকিং হয়নি। কিন্তু কে বা কারা রয়েছে এই হ্যাকিংয়ে পেছনে? একটাই দেশের নাম উঠে এসেছে-চিন।





ফ্ল্যাশব্যাক ২০০৬


২০০৬ সালে স্মার্ট ফোন লঞ্চ হয়নি। কিন্তু তখন একটু বেশি দামের ফিচার ফোনগুলিতে ভিডিয়ো দেখার সুবিধা ছিল। এই বিষয়টি নজরে এসেছিল আমেরিকার ওরেগন শহরের তিনজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের। তারা বুঝতে পেরেছিল, কয়েক বছরের মধ্যে টিভি ও সিনেমা হলের পাশাপাশি ভিডিয়ো দেখার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠবে মোবাইল ফোন। তাই এমন সফটওয়্যার প্রয়োজন যার সাহায্যে হাই রেজলিউশনের ভিডিয়োকে কমপ্রেস করতে হবে যাতে সেগুলিকে মোবাইল ফোন সহ বিভিন্ন সাইজের ডিভাইসে দেখা সম্ভব। তারা তখন একটি কোম্পানি চালু করল যার নাম Elemental Technologies। এই কোম্পানি উন্নত ধরনের একটি সফটওয়্যার তৈরি করল যার সাহায্যে হাই রেজলিউশনের বড় সাইজের ভিডিয়ো ফাইলগুলির কোয়ালিটি একই রেখে সেগুলিকে কমপ্রেস করা সম্ভব এবং সেগুলিকে বিভিন্ন ফরম্যাটে কনভার্ট করাও সম্ভব যাতে সেগুলি কম্পিউটারের পাশাপাশি মোবাইল ফোন, ট্যাব ইত্যাদিতে সহজে দেখা যায়। 





সফটওয়্যার তৈরির পাশাপাশি Elemental Technologies আমেরিকার একটি হার্ডওয়্যার কোম্পানি Super Micro Computer Inc. (যা Supermicro নামেই বেশি পরিচিত)  – এর সঙ্গে চুক্তি করল। চুক্তি অনুসারে Supermicro কোম্পানি Elemental Technologies- এর জন্য সার্ভার তৈরি করবে এবং সেই সার্ভারের চিপে থাকবে বিশেষ সফটওয়্যারটি যা ভিডিয়ো ফাইল কমপ্রেস ও কনভার্ট করার জন্য Elemental Technologies তৈরি করেছে।


সার্ভারের চাহিদা বাড়ল


Elemental Technologies – এর সার্ভার কয়েকবছরের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। সার্ভার তৈরির জন্য খরচ পড়ত প্রায় $ ৩০,০০০/-, কিন্তু সেগুলি বিক্রি হত প্রায় $ ১০০০০০/- ডলারে। অর্থাৎ প্রতিটি সার্ভারের দাম পড়ত প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকা। কিন্তু তবু সেই সার্ভারের চাহিদা ক্রমশ বেড়ে চলল। কারণ ২০০৭ সালে অ্যাপল স্মার্ট ফোন লঞ্চ করার পর মোবাইল ফোনে ভিডিয়ো দেখার পরিমাণ রাতারাতি বেড়ে গেল। শুধু তাই নয়, আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা CIA ড্রোন, স্পাই স্যাটেলাইট এবং আনম্যানড্ এয়ার ভেহিকলের (UAV) মাধ্যমে আকাশপথে বিভিন্ন দেশের উপর গোপনে নজরদারি চালায়। নজরদারি চালানোর সময় যে ভিডিয়ো রেকর্ডিং করা হয় সেগুলির ফাইল সাইজ অনেকটাই বড়। এছাড়া আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা NASA তাদের স্যাটেলাইট ও স্পেসশাটলের মাধ্যমেও মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার ছবি ভিডিয়ো ক্যামেরায় রেকর্ডিং করে। সেগুলির ফাইল সাইজও অনেকটাই বড়। এই বড় সাইজের ভিডিয়ো ফাইলগুলিকে সার্ভারে স্টোর করার সময় কমপ্রেস করার প্রয়োজন হয়। তাই এই সমস্ত সরকারি সংস্থা Elemental Technologies – এর সার্ভার কিনতে শুরু করে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি যারা অনলাইনে সিনেমা ও বিভিন্ন ভিডিয়ো ক্লিপিং (যেমন Youtube) দেখার পরিষেবা দেয় বা ক্লাউড স্টোরেজ পরিষেবা দেয়, তাদের কাছেও Elemental Technologies – এর সার্ভারের চাহিদা বেড়ে গেল। 


অ্যামাজন প্রাইম ভিডিয়ো


২০১৫ সালে অ্যামাজন কোম্পানি ঠিক করল তারা আর একটি কোম্পানি তৈরি করবে (অ্যামাজন প্রাইম ভিডিয়ো) যা মোবাইল, ল্যাপটপ ও ট্যাবে অনলাইনে সিনেমা ও টিভি সিরিয়াল দেখার সুবিধা দেবে। কিন্তু সেজন্য এমন সফটওয়্যার ও সার্ভারের প্রয়োজন পড়ল যার সাহায্যে প্রচুর হাই রেজলিউশনের ভিডিয়ো ফাইলকে বিভিন্ন ফরম্যাটে কমপ্রেস করে স্টোর করতে হবে। তাই অ্যামাজন ঠিক করল তারা Elemental Technologies কোম্পানিকে কিনে নেবে। 


কেনার আগে তদন্ত


যখন একটি কোম্পানি অন্য একটি কোম্পানিকে কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তারা তৃতীয় কোনও (থার্ড পার্টি কোম্পানি) কোম্পানিকে দিয়ে বিশেষ তদন্ত চালায়। Elemental Technologies কোম্পানিকে কেনার আগে তাই অ্যামাজন কোম্পানিও অন্য একটি থার্ড পার্টি কোম্পানিকে তদন্তের দায়িত্ব দিল। সেই কোম্পানির কাজ হবে Elemental Technologies কোম্পানির সফটওয়্যার, সার্ভার ও ব্যবসার পদ্ধতি ঠিকঠাক রয়েছে কিনা তা দেখা। তদন্ত করে সেই থার্ড পার্টি কোম্পানি অ্যামাজনকে যে রিপোর্ট দিল তা দেখে অ্যামাজন কোম্পানি তো হতবাক! কারণ তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে এল। 


তদন্ত রিপোর্ট


আগেই বলেছি যে, Elemental Technologies কোম্পানি তাদের সার্ভার তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিল আমেরিকার Supermicro কোম্পানিকে। তদন্তে দেখা গেল Supermicro কোম্পানি যে সার্ভারগুলি তৈরি করেছে সেগুলির প্রত্যেকটির ভেতর গোপনে একটি মাইক্রোচিপ লাগানো রয়েছে। সেই চিপের সাহায্যে সার্ভারগুলিকে হ্যাক করে সেখানে স্টোর করা যাবতীয় ভিডিয়ো ফাইলকে অ্যাকসেস করা সম্ভব। চালের দানার থেকেও ছোট সেই চিপটিকে এমনভাবে সার্ভারের মাদারবোর্ডে লাগানো হয়েছিল যে, তা খুব ভালো করে পরীক্ষা না করলে বোঝা অসম্ভব।


শুরু হল সরকারি তদন্ত


২০১৫ সালে সেই তদন্ত রিপোর্ট পেয়ে মাথা ঘুরে গেল অ্যামাজন কোম্পানির কর্তাদের। তারা সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি আমেরিকার সরকারকে জানাল। সব শুনে তো আমেরিকার সরকারেরও মাথায় হাত। কারণ Elemental Technologies কোম্পানির সেই সার্ভার CIA, NASA সহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল স্টোর করতে ব্যবহার করা হয়। সেই সমস্ত ফাইল যদি অন্য কোনও দেশের হ্যাকারদের হাতে চলে যায় তাহলে সমূহ বিপদ। ইতিমধ্যে বিষয়টি জানতে পেরে অ্যাপল কোম্পানিও চিন্তায় পড়ল। কারণ অ্যাপলের ক্লাউড স্টোরেজ পরিষেবায় (iCloud- যে ক্লাউড স্টোরেজে অ্যাপলের গ্রাহকরা তাদের বিভিন্ন ফাইল, অ্যাপ হিস্ট্রি, চ্যাট হিস্ট্রি ইত্যাদি স্টোর করে রাখে) Elemental Technologies-র প্রায় ৭০০০ সার্ভার ব্যবহৃত হয়। ব্যাপারটা জানার পর অ্যাপল মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে Elemental Technologies-র সমস্ত সার্ভার সরিয়ে দিয়ে নতুন সার্ভার ইনস্টল করল। 




এদিকে, ব্যাপারটা নিয়ে গোপনে তদন্ত শুরু করল আমেরিকার সরকার। তদন্তে জানা গেল, Supermicro কোম্পানি তাদের ওই সার্ভারগুলি তৈরির অর্ডার দিয়েছিল চিনের সাংহাইতে অবস্থিত একটি কোম্পানিকে। সেখানে সার্ভারগুলি তৈরি করার সময়ই গোপনে মাদারবোর্ডে সেই মাইক্রোচিপ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্পষ্ট বোঝা গেল এটা অনেক বড় মাপের চক্রান্ত। কারণ সাধারণ হ্যাকারদের পক্ষে কোনও কোম্পানিকে প্রভাবিত করে সার্ভারের মাদারবোর্ডের ডিজাইন পালটে দিয়ে সেখানে বিশেষ কোনও চিপ লাগানো সম্ভব নয়। এটা একমাত্র তখনই সম্ভব যদি দেশের সরকারের তরফে সেই কোম্পানিকে তেমন কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়। অর্থাৎ স্পষ্টই বোঝা গেল এই ঘটনা চিন সরকারের বিশেষ নির্দেশ ছাড়া সম্ভব হয়নি। 


তদন্তের ফলাফল


এখনও পর্যন্ত তদন্তে জানা গেছে, আমেরিকার CIA, NASA, অ্যাপল, ফেসবুক সহ ৩০টি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সার্ভারে স্টোর করে রাখা গুরুত্বপূর্ণ ডেটা এভাবে হ্যাকড হয়েছে। কিন্তু এটাতো শুধু আমেরিকার হিসেব। আমেরিকা ছাড়াও বিশ্বের আরও অনেক দেশের বিভিন্ন কোম্পানি ও সরকারি সংস্থা কিন্তু Elemental Technologies-র সার্ভার ব্যবহার করে। সুতরাং চিন এই হার্ডওয়্যার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে আমেরিকা ছাড়াও বিশ্বের আরও অনেক দেশের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যে চুরি করেছে তা বলাইবাহুল্য। 


ফোন ও কম্পিউটার কি সুরক্ষিত?


এখন যে প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল শুধু কী এভাবে Elemental Technologies-র সার্ভারগুলিকে হ্যাক করা হয়েছে? প্রশ্নটা এজন্য উঠছে, কারণ প্রতিবছর বিশ্বে যত মোবাইল ফোন তৈরি করা হয় তার ৭৫% এবং যত পিসি ও ল্যাপটপ তৈরি হয় তার ৯০% চিনে তৈরি হয়। এর কারণ সে দেশে শ্রমিকদের বেতন খুবই কম। তাই বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি তাদের ফোন, কম্পিউটার ও সার্ভার চিনের বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে তৈরি করে। এখন প্রশ্ন হল, ওই সমস্ত ফোন ও কম্পিউটারের মাদারবোর্ডেও গোপনে এমন চিপ লাগিয়ে দেওয়া হয়নি তো? যদি তেমনটা হয় তবে সেটা আরও ভয়ংকর। 


মুখে কুলুপ


গতকাল চিনের এই হার্ডওয়্যার হ্যাকিংয়ের বিষয়টি ফাঁস করেছে আমেরিকার Bloomberg নামে একটি সংবাদ সংস্থা। যদিও বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে আমেরিকার সরকার এবং অ্যাপল সহ বিভিন্ন কোম্পানি যারা এই হ্যাকিংয়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল চিনের সরকারের তরফেও এই হ্যাকিংয়ের অভিযোগ কিন্তু সরাসরি অস্বীকার করা হয়নি। সে দেশের সরকার একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘চিন নিজেও বিভিন্ন সময়ে সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছে। সাইবার ক্রাইম বন্ধ করতে চিন সরকার সর্বদা তৎপর।’ এই বিবৃতিতে কিন্তু কোথাও চিন Elemental Technologies-র সার্ভার হ্যাকিংয়ের বিষয়টি নিয়ে কোনও কথা বলেনি বা তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেনি। 





টেকনোবিটসের এই ব্লগটি পড়ে যদি ভালো লাগে তবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করুন। কমেন্ট করুন ব্লগের নীচে বা টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে।


টেকনোবিটসের ব্লগগুলি যদি নিজের ফেসবুক নিউজ ফিডে পেতে চান, তবে টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে গিয়ে Follow বাটন ক্লিক করে তারপর See first অপশনটিতে ক্লিক করুন। ইমেল সাবস্ক্রিপশনের  জন্য টেকনোবিটসের ব্লগ সাইটে নিজের ইমেল আইডি সাবমিট করে রেজিস্ট্রেশন করুন। ধন্য়বাদ। 


13 comments:

  1. How to share it in whatsapp? In sharing mode, whatsapp is not available.

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা খুব অদ্ভুত যে, গুগল এখনও তাদের ব্লগসাইটে হোয়াটসঅ্যাপ শেয়ার বাটন অপশন রাখেনি। যাই হোক আপনি নিচের লিঙ্কটি কপি করে সেটি হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করতে পারবেন।
      https://bit.ly/2pBM82d

      Delete
  2. কি ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা। China তো দেখছি গোপনে অবৈধ কাজকর্ম করতে সিদ্ধহস্ত। ফোন, কম্পিউটারের সিস্টেম সফটওয়্যারে হ্যাকিং -এর জন্য গোপনে সফটওয়্যার কোড ইনস্টল করা থেকে শুরু করে সার্ভারের মাদারবোর্ডে বিশেষ চিপ বসানো, সবেতেই খুব পারদর্শী। সারাবিশ্বের Privacyটাই এখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাড়িয়ে গেল। খুবই চিন্তাজনক একটা খবর।

    যাই হোক, ভয়ংকর ভালো একটা ঘটনা। অসম্ভব ভালো একটা পোস্ট পড়লাম আবারও। ধন্যবাদ স্যার আপনাকে। ভালো থাকবেন।

    ReplyDelete
  3. Tahole ki chine product sob mobile e hacking chip bosano sobvona royechhe !!??

    ReplyDelete
  4. It is an acceptable fact that while on internet we will have to open our privacy and work on.Whatever caution we take, hackers do not sit idle. So when we use internet our privacy may be leaked this way or that way.After this another scam may come into limelight.However,we must not disclose important thing as far as possible and do most of the works manually if possible.

    ReplyDelete
  5. খুব ভালো পোস্ট......
    ধন্যবাদ।

    ReplyDelete

জনপ্রিয় পোস্ট