21 Sept 2018

সাবধান! ফোন করে কেউ ইমেল আইডি চায়নি তো?

Image Credit: Pixabay
সমীর চৌধুরি একজন স্কুল শিক্ষক। একদিন সকালে তিনি যখন স্কুলে যাবেন বলে রেডি হচ্ছেন তখন হঠাৎ তাঁর মোবাইল ফোনটি বেজে উঠল। অচেনা নাম্বার থেকে ফোন। সমীরবাবু ফোনটি ধরতেই ওপার থেকে একজন যুবক অত্যন্ত ভদ্রভাবে ইংরেজিতে প্রশ্ন করল, ‘আমি কি সমীর চৌধুরির সঙ্গে কথা বলছি?’… 




সমীরবাবুর সঙ্গে সেই যুবকের ফোনে যা কথা হল


- আমি কি সমীর চৌধুরির সঙ্গে কথা বলছি?’

- হ্যাঁ, আমি সমীর চৌধুরি। কিন্তু আপনি...?

- নমস্কার, আমি *** ব্যাঙ্কের থেকে অলোক রায় কথা বলছি। আপনার তো *** ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তাই না?

- হ্যাঁ, বলুন।

- আসলে আমাদের ব্যাঙ্ক অল্প কিছু গ্রাহকের জন্য একটি বিশেষ অফার চালু করেছে। সেই গ্রাহকদের তালিকায় আপনিও রয়েছেন। সীমিত সময়ের এই অফারে আপনি যদি ১ লাখ টাকা ছয়মাসের জন্য ফিক্সড করেন, তবে মাত্র ছয়মাসের মেয়াদে আপনাকে সুদ সমেত ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। আপনি যদি এই বিশেষ অফারটি নিতে ইচ্ছুক থাকেন, তবে আমরা এই অফারের বিস্তারিত নিয়মাবলি ও লিঙ্ক আপনাকে মেল করে পাঠাতে পারি। আপনি কি আপনার মেল আইডি বলবেন স্যার?

- না…মানে আমি এখনই ঠিক বুঝতে পারছি না অফারটি নেব কি না…তবে আমার মেল আইডি আপনাকে দিচ্ছি। আপনি আমাকে মেলটি পাঠান…আমি ভেবে দেখব। আমার মেল আইডি হল *****@gmail.com।

- থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। ধন্যবাদ আপনার সহযোগিতার জন্য। আপনার দিনটি শুভ হোক।


ইমেল এল


পরের দিনই সমীরবাবুর জিমেল অ্যাকাউন্টে একটি মেল হল। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে রাতে সমীরবাবু মেল চেক করলেন। সমীরবাবুর যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট রয়েছে সেই ব্যাঙ্কের লোগো রয়েছে মেলের উপরে। মেলে লেখা রয়েছে, সমীরবাবু যেহেতু ওই ব্যাঙ্কের দীর্ঘদিনের একজন গ্রাহক। তাই তাঁকে এই বিশেষ অফারটি দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে অফারের বেশ কিছু নিয়ম বা শর্তও লেখা রয়েছে মেলে। যেমন, টাকা ফিক্সড করার পর ছয়মাসের আগে তিনি সেই টাকা তুলতে পারবেন না। ছয়মাস পর তিনি সুদে আসলে যে টাকা পাবেন তা ভারত সরকারের আয়কর বিভাগের নিয়ম অনুসারে ট্যাক্সের আওতায় পড়বে ইত্যাদি ইত্যাদি। 



সমীরবাবু মেলটি খুঁটিয়ে পড়লেন। ব্যাঙ্ক থেকে বিভিন্ন সময়ে তাদের গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন অফার ঘোষণা করে যেমন মেল পাঠানো হয়, এই মেলটিও ঠিক তেমনি। মেলের একদম শেষে লেখা রয়েছে, সমীরবাবু যদি এই অফারটি নিতে ইচ্ছুক থাকেন, তবে তাঁকে মেলের নিচে দেওয়া লিঙ্কে ক্লিক করে ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে গিয়ে অনলাইনে ১ লাখ টাকা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জমা করতে হবে। টাকা জমা দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যাঙ্ক থেকে সমীরবাবুকে ফিক্সড ডিপোজিটের সার্টিফিকেটের সফটকপি মেল করে পাঠানো হবে। এছাড়া সমীরবাবু ইচ্ছা করলে ব্যাঙ্কে গিয়ে সেই সার্টিফিকেটের হার্ডকপিও সংগ্রহ করতে পারবেন। 


টাকা জমা 


পরের দিনই সমীরবাবু মেলের নিচে দেওয়া ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটের লিঙ্কে ক্লিক করলেন। ক্লিক করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইট ওপেন হল। সমীরবাবু সেখানে দেখলেন ফিক্সড ডিপোজিটে টাকা দেওয়ার অপশন রয়েছে। সেই অপশনে ক্লিক করে সমীরবাবু তাঁর সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে ১ লাখ টাকা ট্রান্সফার করলেন।


ফিক্সড ডিপোজিট সার্টিফিকেট


টাকা ট্রান্সফার করার পর ২৪ ঘণ্টা কেটে গেল কিন্তু সমীরবাবুর মেলে ফিক্সড ডিপোজিটের সার্টিফিকেটের কোনও সফটকপি এল না। সমীরবাবু তিন দিন অপেক্ষা করলেন, চতুর্থ দিন ব্যাঙ্কে গেলেন বিষয়টি নিয়ে খোঁজ করতে। 

সমীরবাবুর কাছ থেকে সব শুনে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার তো আকাশ থেকে পড়লেন। ম্যানেজার বললেন, ‘আপনাকে ব্যাঙ্ক থেকে কেউ ফোন করেছিল? কিন্তু এমন কোনও স্পেশাল অফারের কথা তো আমাদের জানা নেই! ঠিক আছে, আপনি একটু ওয়েট করুন, আমি হেড অফিসের সঙ্গে কথা বলছি।’

ম্যানেজার মুম্বইতে ব্যাঙ্কের হেড অফিসের সঙ্গে কথা বললেন। কিন্তু সেখান থেকেও জানানো হল যে, তাদের তরফে এমন কোনও অফার চালু করা হয়নি 



সমীরবাবু রেগে গেলেন। তিনি বললেন, ‘হতেই পারে না। আপনাদের ব্যাঙ্ক থেকেই আমাকে মেল করা হয়েছে। সেই মেল আমার অ্যাকাউন্টে রয়েছে। আমি ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে গিয়ে টাকা ট্রান্সফার করেছি। আমি আপনাদের দীর্ঘদিনের গ্রাহক। আমাকে আপনারা এভাবে হ্যারাস করতে পারেন না। আমি পুলিশে আপনাদের বিরুদ্ধে কমপ্লেন করব।’


পুলিশে কমপ্লেন


শেষ পর্যন্ত সমীরবাবুকে পুলিশের কাছে কমপ্লেন করতেই হল। কিন্তু ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে নয়, কোনও এক অজানা দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে যে ব্যাঙ্ককর্মী সেজে সমীরবাবুর সঙ্গে প্রতারণা করে ১ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অভিযোগের এফআইআর-এর সঙ্গে সমীরবাবু ফোন নাম্বার (যে নাম্বার থেকে তাঁর কাছে প্রথমদিন ফোন এসেছিল, যদিও সেই নাম্বারটি এখন সুইচড অফ) এবং ইমেলের (তাঁকে যে মেলটি পাঠানো হয়েছিল) কপি জমা দিলেন। পুলিশ তদন্ত করছে কিন্তু যথারীতি সেই প্রতারক এখনও ধরা পড়েনি।


ফিশিং সাইট


কীভাবে সমীরবাবুর কাছ থেকে দুষ্কৃতীরা টাকা হাতিয়ে নিল? এটা করা হয়েছে ফিশিং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। সমীরবাবুকে ব্যাঙ্কের নাম করে যে মেলটি পাঠানো হয়েছিল সেটি ছিল একটি নকল মেল যা আসলে দুষ্কৃতীরা সমীরবাবুকে পাঠিয়েছিল। 
মেলের নিচে ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটের যে লিঙ্কটি দেওয়া ছিল, সেটি ব্যাঙ্কের আসল ওয়েবসাইটের লিঙ্ক নয়। দুষ্কতীরা ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটের মতো দেখতে একটি নকল ওয়েবসাইট তৈরি করেছিল। কোনও প্রতিষ্ঠানের আসল ওয়েবসাইটের মতো দেখতে এই ধরণের নকল ওয়েবসাইটকে বলা হয় ফিশিং সাইট। সেই ফিশিং সাইটের লিঙ্কটি সমীরবাবুকে পাঠানো মেলের নীচে দু্ষ্কৃতীরা পেস্ট করে দিয়েছিল। 

এই ধরণের ফিশিং সাইটগুলি দেখতে অবিকল আসল ওয়েবসাইটের মতো হয়। তাই সমীরবাবু ভেবেছিলেন তিনি বোধহয় ব্যাঙ্কের আসল ওয়েবসাইটে গিয়ে টাকা জমা দিয়েছেন। কিন্তু সেই ফিশিং সাইটে টাকা জমা দেওয়ার অপশনের সঙ্গে দুষ্কৃতীদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট লিঙ্ক করা ছিল। তাই সেই অপশনে ক্লিক করে সমীরবাবু যে টাকা ট্রান্সফার করেছেন সেই টাকা ফিক্সড ডিপোজিটে ট্রান্সফার না হয়ে দু্ষ্কৃতীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়েছে। 


পরিসংখ্যান


গত দুই মাসে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে পুলিশের কাছে এমন ১৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ১৮টি ঘটনার মধ্যে ১০টি ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীরা দেশের বিভিন্ন রাজ্যের ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের ফোন করেছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে। বাকি ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীদের ফোন এসেছিল রাজস্থান থেকে। অর্থাৎ এই নতুন ধরনের প্রতারণায় জড়িত দুষ্কৃতীদের চক্রটি মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও রাজস্থান থেকে কাজ করছে। 


সতর্ক হন


ব্যাঙ্ককর্মী পরিচয় দিয়ে কেউ ফোন করে এমন কোনও অফারের প্রলোভন দিলে তাকে নিজের মেল আইডি বা অন্যান্য তথ্য জানাবেন না। তার বদলে ব্যাঙ্কে গিয়ে খোঁজ নিন এমন কোনও অফার বাস্তবে ব্যাঙ্কের থেকে দেওয়া হচ্ছে কি না। অনেক ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীরা বিমা কোম্পানির এজেন্ট সেজেও ফোন করে। সেক্ষেত্রেও সতর্ক থাকবেন। 

ইমেলে পাঠানো কোনও লিঙ্কে ক্লিক করে টাকা ট্রান্সফার করবেন না। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা ট্রান্সফার করতে হলে সর্বদা গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর থেকে ডাউনলোড করা ব্যাঙ্কের অফিশিয়াল অ্যাপ ব্যবহার করুন। 

কম্পিউটারের মাধ্যমে টাকা ট্রান্সফার করতে হলে ব্রাউজারের অ্যাড্রেসবারে ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটের URL ভালো করে চেক করুন। এছাড়া ওয়েবসাইটে দেওয়া বিভিন্ন অপশনের উপর মাউজের কার্সর রেখে লিঙ্ক ভেরিফাই করুন। 


কম্পিউটারে ফিশিং সাইট কীভাবে চেক করবেন


ধরা যাক আপনার স্টেট ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। স্টেট ব্যাঙ্কের অরিজিনাল ওয়েবসাইটের URL হল sbi.co.in। এবার স্টেটব্যাঙ্কের ওয়েবসাইট ওপেন করার পর দেখবেন সেটির হোম পেজে বিভিন্ন অপশন রয়েছে। যেমন, ‘Personal Banking’, ‘International Banking’, ‘Service’ ইত্যাদি। সেই অপশনগুলির উপর মাউজের কার্সর নিয়ে যান এবং ডেস্কটপের একেবারে নিচে বাঁ দিকে দেখুন কোন URL শো করছে। যদি সেটি আসল ওয়েবসাইট হয়, তবে প্রতিক্ষেত্রেই ডেস্কটপের নিচে বাঁ দিকে sbi.co.in শো করবে, অর্থাৎ যে URL ব্রাউজারের অ্যাড্রেসবারে শো করছে, সেটাই ডেস্কটপের নিচে শো করবে। যদি তা না শো করে, তাহলে বুঝবেন সাইটটি আসল নয়। কম্পিউটারে যে কোনও ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইট এভাবে আপনি চেক করে দেখে নিতে পারবেন যে সেটি অরিজিনাল, না ফিশিং সাইট।




টেকনোবিটসের এই ব্লগটি জনস্বার্থে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে ও ইমেলে শেয়ার করুন। কমেন্ট করুন ব্লগের নীচে বা টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে।


টেকনোবিটসের ব্লগগুলি যদি নিজের ফেসবুক নিউজ ফিডে পেতে চান, তবে টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে গিয়ে Follow বাটন ক্লিক করে তারপর See first অপশনটিতে ক্লিক করুন। ইমেল সাবস্ক্রিপশনের  জন্য টেকনোবিটসের ব্লগ সাইটে নিজের ইমেল আইডি সাবমিট করে রেজিস্ট্রেশন করুন। ধন্য়বাদ। 


1 comment:


  1. Present caption means if i will give email id then i will loose money.
    I am ur fan from many years back in UB.sambad and have respect for you.and i have all collection of your technobits pdf till this blog hasn't created.
    After clicking this caption on ur blog got a doubt in my mind that whether i will be fooled after giving someone my email.but after reading it fully came to conclusion which is all i know.
    So dont give such double meaning captions.

    ReplyDelete

জনপ্রিয় পোস্ট