26 Aug 2018

পুলিশি তল্লাশি ঠেকাতে অ্যান্ড্রয়েডের নতুন ফিচার লকডাউন

Image credit: Pixabay

ধরুন, আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তায় পুলিশের নাকা চেকিং চলছে। পুলিশ আপনাকে থামাল। আপনার পকেটে বা ব্যাগে কোনও আপত্তিকর কিছু লুকানো রয়েছে কি না, তল্লাশি করে দেখল। তারপর পুলিশ আপনার মোবাইল ফোনটি চাইল। কেন? কারণ, আপনার ফোনটি আনলক করে পুলিশ সার্চ করে দেখবে সেখানে কোনও আপত্তিকর মেসেজ বা অন্য কিছু রয়েছে কিনা। 


দুটি প্রশ্ন

এখন প্রথম প্রশ্ন হল, পুলিশ কি সন্দেহের বশে আপনার ফোনটি আনলক করে সার্চ করতে পারে? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, পুলিশ যদি আপনার ফোন সার্চ করতে চায় এবং আপনাকে নির্দেশ দেয় ফোনটি আনলক করতে, সেক্ষেত্রে আপনি কি পুলিশের নির্দেশ মানতে বাধ্য? প্রশ্নগুলি জটিল যার স্পষ্ট উত্তর কারও কাছে নেই।



ছয় মাস জেল


সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সেদেশের ফ্লোরিডা রাজ্যে উইলিয়াম জন মন্টানেজ (William John Montanez) নামে এক ব্যক্তি গাড়িতে গাঁজা নিয়ে যাচ্ছিলেন। ফ্লোরিডায় গাঁজা নিয়ে যাওয়া (transportation) কোনও অপরাধ নয়। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চেকিংয়ের সময় সেই গাঁজা পুলিশের নজরে পড়ে। এরপর পুলিশ উইলিয়ামের মোবাইল ফোনটি সার্চ করতে চায়। তারা উইলিয়ামকে নির্দেশ দেয় ফোনটি আনলক করতে। উইলিয়াম সাফ জানিয়ে দেয়, ফোনে তাঁর অনেক ব্যক্তিগত ডেটা স্টোর করা রয়েছে, সে ফোন আনলক করবে না। পুলিশ উইলিয়ামকে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে ফের তারা উইলিয়ামকে ফোনটি আনলক করার নির্দেশ দেয়। উইলিয়াম দাবি করে, সে ফোন আনলক করার পাসওয়ার্ড ভুলে গিয়েছে। এরপর উইলিয়ামকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বিচারে উইলিয়ামের ছয় মাসের জেল হয়। না, গাঁজা রাখার জন্য নয়, ফোনটি কেন পুলিশের কাছে আনলক করেনি সেজন্য তাঁর এই শাস্তি।


দুটি সমস্যা


উইলিয়ামের এই ঘটনার পর আমেরিকা জুড়ে হইচই শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে অন্যান্য দেশেও। প্রশ্ন হল, পুলিশ চাইলেই কি আমরা - সাধারণ নাগরিকরা- পুলিশকে আমাদের ফোন সার্চ করতে দেব? একপক্ষ বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ কোনও ব্যক্তির ফোন সার্চ করতেই পারে। কিন্তু অন্যপক্ষ (তারা সংখ্যায় বেশি) বলছে, নেহাত সন্দেহের বশে পুলিশ বা অন্য নিরাপত্তা সংস্থা কোনও ব্যক্তির ফোন সার্চ করতে পারে না। কারণ আজকাল ফোনে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যক্তিগত ডেটা স্টোর করে রাখি। ব্যক্তিগত ডেটা যেমন, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক চ্যাট হিস্ট্রি, SMS, ব্যক্তিগত ছবি ইত্যাদি। গুরুত্বপূর্ণ ডেটা যেমন, ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নাম্বার, ATM কার্ডের PIN ও CVV, বিভিন্ন অনলাইন অ্যাকাউন্টের আইডি এবং পাসওয়ার্ড, অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ইত্যাদি। 

পুলিশকে যদি ফোন আনলক করে দেওয়া হয়, তাহলে পুলিশ ফোনে স্টোর করা সেই সমস্ত তথ্য জেনে যাবে। সেক্ষেত্রে দুটি সমস্যা হবে –

১. ফোনে স্টোর করা ব্যক্তিগত তথ্য পুলিশ জেনে গেলে আমার প্রাইভেসি অর্থাৎ ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। 

২. ফোনে স্টোর করা গুরুত্বপূর্ণ ডেটা (ব্যাঙ্কিং ও অফিশিয়াল ডেটা) পুলিশ জেনে যাওয়ার পর তাদের কাছ থেকে কোনওভাবে সেই তথ্য অন্য কারও কাছে চলে গেলে আর্থিক ও পেশাগত ক্ষেত্রে আমাকে ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে। 


রাষ্ট্রের নজরদারি


কিন্তু ভারতই বলুন বা আমেরিকা - রাষ্ট্র সর্বদাই চায় নাগরিকদের নজরবন্দি রাখতে। তাদের অনলাইন অ্যাক্টিভিটির উপর নজর রাখতে। ব্ল্যাকবেরি কোম্পানির মেসেজিং সার্ভিস খুব জনপ্রিয় ছিল কারণ তারা এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশনের সুবিধা দিত। অর্থাৎ যিনি মেসেজটি পাঠাচ্ছেন এবং যাঁকে পাঠানো হচ্ছে, সেই দুইজন ছাড়া আর কেউ মেসেজটি পড়তে পারত না। ভারত সরকার ব্ল্যাকবেরি কোম্পানিকে অনুরোধ করেছিল, এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন তুলে দিতে, যাতে দেশের পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি (CBI, RAW) সেই মেসেজ পড়তে পারে। কিছুদিন আগে হোয়াটসঅ্যাপ কোম্পানিকেও ভারত সরকার একই অনুরোধ করেছে। যদিও হোয়াটস্অ্যাপ তাতে রাজি হয়নি। গুগল এবং অ্যাপলকে একই অনুরোধ করেছিল আমেরিকার সরকার। কিন্তু তারাও রাজি হয়নি। 


যদিও কোম্পানিগুলি এই অনুরোধে রাজি না হলেও বিভিন্ন দেশের সরকার তথা পুলিশ ও নিরাপত্ত এজেন্সিগুলিও বসে নেই। তারা বলপ্রয়োগ করে বা অন্য কোনও উপায়ে নাগরিকদের ফোন সার্চ করার নানা উপায় অবলম্বন করে। যেমন, উইলিয়ামের ঘটনার পর আমেরিকায় অনেক বাসিন্দাই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশ বিনা কারণে নিছক সন্দেহের বশে তাঁদের থানায় নিয়ে গিয়েছে এবং জোর করে ফোন আনলক করতে বাধ্য করেছে। 


কীভাবে জোর করা হয়েছে? 


এখন অনেকেই ফোনে টাচ আইডি (বায়োমেট্রিক আনলক সিস্টেম) ব্যবহার করেন। অর্থাৎ ফোনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট বাটনে আঙুল চেপে ধরলেই ফোন আনলক হবে। এছাড়া অ্যাপলের নতুন ফোনে রয়েছে ফেস আনলক সিস্টেম। এক্ষেত্রে ফোনটি মুখের সামনে ধরলেই ফোন আনলক হবে। অনেকের অভিযোগ, পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে জোর করে ফোনের হোম বাটনের উপর আঙুল চেপে রেখে বা মুখের সামনে ফোন ধরে ফোন আনলক করিয়েছে। 


অ্যাপলের নতুন ফিচার


এই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর মাসখানেক আগে অ্যাপল তাদের iOS অপারেটিং সিস্টেমে একটি নতুন ফিচার অ্যাড করেছে। সেটি হল, যদি বিশেষ কোনও পরিস্থিতিতে পড়ে আপনি আইফোনের অন-অফ বাটনটি পরপর পাঁচবার দ্রুত প্রেস করেন, তাহলে ফোনের ফেসআইডি এবং টাচআইডি কাজ করবে না। অর্থাৎ পুলিশ যদি জোর করে তবু তারা আপনার আঙুলের ছাপের সাহায্যে বা ফোনটিকে মুখের সামনে ধরে সেটি আনলক করতে পারবে না। 


পুলিশের পালটা টেকনিক


কিন্তু অ্যাপলের এই ফিচারের মোকাবিলায় আমেরিকার পুলিশও নতুন পদ্ধতি বের করে ফেলেছে। তারা এখন গ্রেকি (দাম $১৫০০০) নামে একটি যন্ত্র ব্যবহার করছে। গ্রেশিফট নামে একটি কোম্পানির তৈরি এই যন্ত্রটিকে কেবলের সাহায্যে আইফোন বা আইপ্যাডের ইউএসবি পোর্টের সঙ্গে কানেক্ট করে সেগুলিকে আনলক করা সম্ভব। 

পুলিশ এই ডিভাইসের ব্যবহার শুরু করার কিছুদিন পরেই অ্যাপল ফের তাদের অপারেটিং সিস্টেমে নতুন একটি ফিচার অ্যাড করেছে। এই ফিচারের নাম ইউএসবি রেস্ট্রিক্টেড মোড। এই মোড যদি অন থাকে, তাহলে আইফোন বা আইপ্যাডের ইউএসবি পোর্ট কাজ করবে না। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে পুলিশ যদি আইফোন বা আইপ্যাডের ইউএসবি পোর্টে গ্রেকি ডিভাইসটি কেবল দিয়ে কানেক্ট করে তাহলেও ফোন বা প্যাড আনলক সম্ভব নয়। 

কিন্তু পুলিশও কম যায় না। তারা এখন বিশেষ একটি ডঙ্গল ব্যাবহার করছে (দাম মাত্র $৩৯) যার সাহায্যে ইউএসবি রেস্ট্রিক্টেড মোড অন থাকলেও গ্রেকি যন্ত্রটি দিয়ে আইফোন বা আইপ্যাড আনলক করা সম্ভব।


লকডাউন


অ্যাপলের দেখাদেখি গুগলও তাদের অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের নতুন ভার্সনে (অ্যান্ড্রয়েড পাই) একটি বিশেষ ফিচার অ্যাড করেছে যার নাম ‘Lockdown’।
screenshot property of teknowbits
এই ফিচারটিকে ম্যানুয়ালি ফোনে এনাবেল করতে হবে। এজন্য ফোনের সেটিংসে গিয়ে পরপর ট্যাপ করুন Security & location-Lock screen preferences-Show lockdown option। এই অপশনের পাশে টগল সুইচটি অন করুন। এবার ব্যাক করে ফোনের হোম স্ক্রিনে আসুন। ফোনের পাওয়ার বাটনটি কিছুক্ষণ প্রেস করে রাখুন। দেখবেন স্ক্রিনে ‘পাওয়ার অফ’, ‘রিস্টার্ট’, ‘স্ক্রিনশট’ এবং ‘লকডাউন’ বাটন শো করছে। ‘লকডাউন’ বাটনটি ট্যাপ করলে এই অপশনটি এনাবেল হবে এবং ফোনটির টাচআইডি তখন কাজ করবে না অর্থাৎ ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাহায্যে ফোন আনলক করা যাবে না। একমাত্র পাসওয়ার্ড বা প্যাটার্নের সাহায্যেই তখন ফোন আনলক করা সম্ভব।

এই অপশনটি আপাতত অ্যান্ড্রয়েডের পাই-এর বিটা ভার্সনে রয়েছে। অ্যান্ড্রয়েড পাই অফিশিয়ালি লঞ্চ হওয়ার পর যাঁরা তাঁদের ফোন পাই-তে আপগ্রেডে করার সুবিধা পাবেন তাঁরা এই ফিচারটি ব্যবহার করতে পারবেন। এখন দেখার, পুলিশ ও নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি লকডাউন ফিচারের মোকাবিলায় পালটা নতুন কী উপায় বের করে।



টেকনোবিটসের এই ব্লগটি পড়ে যদি ভালো লাগে তবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করুন। কমেন্ট করুন ব্লগের নীচে বা টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে।


টেকনোবিটসের ব্লগগুলি যদি নিজের ফেসবুক নিউজ ফিডে পেতে চান, তবে টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে গিয়ে Follow বাটন ক্লিক করে তারপর See first অপশনটিতে ক্লিক করুন। ইমেল সাবস্ক্রিপশনের  জন্য টেকনোবিটসের ব্লগ সাইটে নিজের ইমেল আইডি সাবমিট করে রেজিস্ট্রেশন করুন। ধন্য়বাদ। 



2 comments:

  1. গ্রাহকের Privacy ও security রক্ষার্থে 'Apple' যতটা সক্রিয়, অন্যান্য কোম্পানিগুলো অতটাও সক্রিয় নয়।
    'Apple' discovers, others imitate it.

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ পোস্ট।

    ReplyDelete

জনপ্রিয় পোস্ট