30 Aug 2018

অ্যান্ড্রয়েড ফোনে নচ ডিসপ্লে কি খুব প্রয়োজন ছিল?

অ্যাপলের আইফোন এক্স-এর নকল করে ইতিমধ্যে চিনের হুয়েই, ওয়ান প্লাস কোম্পানিগুলি তাদের অ্যান্ড্রয়েড ফোনে নচ ডিসপ্লে ব্যবহার শুরু করেছে। আমি এবং আমার মতো আরও অনেকে যারা টেকনোলজির দুনিয়ার একটু-আধটু খোঁজখবর রাখে তারা ভেবেছিল, গুগল আত্মসম্মানের কথা ভেবে অ্যান্ড্রয়েড (OEM-Original Equipment Manufacturer) ফোন তৈরি করে যে কোম্পানিগুলি, তাদের অ্যাপলের নচ ডিসপ্লের অনুকরণ করতে নিষেধ করবে। কিন্তু গুগল তা করেনি। উলটে গুগল তাদের নতুন ফোন পিক্সল (পিক্সল থ্রি এক্স এল)-এর হ্যান্ডসেটে নচ ডিসপ্লে ব্যবহার করবে বলে জানা গেছে। পিক্সল থ্রি এক্স এল এখনও লঞ্চ হয়নি, তবে অসমর্থিত সূত্রে ফোনটির যে ছবি পাওয়া গিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সেটির উপরে আইফোন এক্স-এর মতো নচ ডিসপ্লে রয়েছে। অ্যাপলের এই অন্ধ অনুকরণের জেরে গুগল বিতর্কের মুখে পড়েছে। 



গুগলের নির্দেশিকা


কিন্তু বিতর্ক শুরু হলেও গুগল কিন্তু অ্যাপলের আইফোনের নকল করে অ্যান্ড্রয়েড ফোনেও নচ ডিসপ্লে চালু করতে উঠেপড়ে লেগেছে। চলতি বছরের অক্টোবরেই গুগল লঞ্চ করছে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের নতুন ভার্সন পাই। এই ভার্সনটিকে গুগল নচ ডিসপ্লের উপযোগী করে (কমপ্যাটিবল) তৈরি করেছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি গুগল অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ডেভেলপার ও OEM –দের জন্য নির্দেশিকা জারি করেছে। নির্দেশিকা অনুসারে ফোনের বেজেল-এ যেন সর্বোচ্চ দুটি নচ থাকে। অর্থাৎ ওই নির্দেশিকার মাধ্যমে গুগল পরোক্ষে বলতে চেয়েছে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে যেন আইফোনের মতোই সাধারণত একটি বা খুব বেশি হলে দুটি নচ থাকে। অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ডেভেলপারদেরও গুগল নির্দেশ দিয়েছে নচ ডিসপ্লের কথা মাথায় রেখে তাঁরা যেন তাঁদের অ্যাপগুলির ইন্টারফেসে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে। 



নচ ডিসপ্লে কাকে বলে তা জানার আগে জেনে নেওয়া যাক কাকে বলে বেজেল।



বেজেল এবং আইফোন


২০০৭ সালে অ্যাপল বিশ্বের প্রথম স্মার্ট ফোন তৈরি করেছিল। সেই
Image Credit: Pixabay
আইফোনে হোম বাটন ছাড়া আর কোনও বাটন ছিল না। অর্থাৎ সেটি ছিল টাচ ফোন। ফোনের স্ক্রিন সাইজ ছিল ৩.৫ ইঞ্চি। কিন্তু ফোনটির দৈর্ঘ্য (height) এবং প্রস্থ (width)  ছিল যথাক্রমে ৪.৫ ইঞ্চি এবং ২.৪ ইঞ্চি। অর্থাৎ ফোনের সামনের অংশের পুরোটা জুড়ে স্ক্রিন বা ডিসপ্লে ছিল না। স্ক্রিনের চারপাশে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ছিল বর্ডার (ছবিটি লক্ষ্য করুন)। ফোনের স্ক্রিনের চারপাশে এই বর্ডারকে বলা হয় বেজেল (Bezel)।


বেজেল-এর ব্যবহার


স্মার্টফোনের প্রথম যুগে ডিসপ্লের নীচের দিকে বেজেল-এ থাকত হোম বাটন ও নেভিগেশন বাটন। এছাড়া ডিসপ্লের উপরে ও নীচের বেজেল-এ থাকত কথা বলা ও কথা শোনার জন্য স্পিকার। এর কয়েক বছর পর ফোনে সেলফি ক্যামেরা অর্থাৎ ফ্রন্ট ক্যামেরার প্রচলন শুরু হয়। সেই ক্যামেরা থাকত ডিসপ্লের উপরের দিকের বেজেল-এ। আরও কয়েক বছর পর ফোনে ফিঙারপ্রিন্ট সেনসরের ব্যবহার শুরু হয়। সেই সেনসর থাকত ডিসপ্লের নীচের দিকে বেজেল-এ। 


বেজেল ক্রমশ সরু হল


সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্মার্ট ফোনের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের উন্নতির পাশাপাশি ফোন কোম্পানিগুলি আর যে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছিল সেটা হল ফোনের ডিসপ্লে বা স্ক্রিনের সাইজ বাড়ানো। প্রথম দিকে ডিসপ্লে সাইজ বাড়ানোর জন্য সামগ্রিকভাবে ফোনের সাইজ বাড়ানো শুরু হয়। এর জেরে ২০১১-২০১২ সাল নাগাদ স্মার্ট ফোনের সাইজ ক্রমশই বাড়ছিল। কোনও কোনও কোম্পানির ফোনের সাইজ প্রায় ট্যাবের মতো হয়ে গিয়েছিল। সেই বড় সাইজের ফোনগুলিকে বলা হত ফ্যাবলেট (ফোন+ট্যাবলেন=ফ্যাবলেট)। এই ফোনগুলিতে নিঃসন্দেহে ডিসপ্লে অনেকটাই বড় ছিল, কিন্তু সেজন্য সামগ্রিকভাবে ফোনের সাইজ এতটাই বড় হয়ে যেত যে, ফোন ক্যারি করতে ও ব্যবহার করতে সমস্যা হত।

ফোন কোম্পানিগুলি বুঝল, এমন কোনও উপায় বের করতে হবে যাতে ফোনের সাইজ সামগ্রিকভাবে বাড়বে না, কিন্তু ডিসপ্লের সাইজ বাড়বে। তখন তাদের নজর পড়ে বেজেল-এ। ডিসপ্লের চারপাশে বেজেল অনেকটা জায়গা নষ্ট করে। যদি কোনও ভাবে বেজেল-কে সরু করা যায়, তাহলে ফোনের সাইজ না বাড়িয়েই ডিসপ্লের সাইজ কিছুটা বাড়ানো সম্ভব। 

এরপর কোম্পানিগুলি বেজেল-এর সাইজ কমাতে শুরু করল। অর্থাৎ স্ক্রিনের চারপাশে বেজেল ক্রমশ সরু হতে শুরু করল। বেজেল-এর সাইজ কমানোর জন্য ফিঙারপ্রিন্ট সেনসরকে ফোনের পেছনে সরিয়ে দেওয়া হল। কথা বলা ও শোনার স্পিকারও ফোনের পেছনের দিকে বা ধারে নিয়ে যাওয়া হল। নেভিগেশন বাটন বেজেল থেকে সরিয়ে ডিসপ্লের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। এইভাবে গত কয়েক বছর ধরে বেজেল থেকে বিভিন্ন ফিচারগুলি সরিয়ে বেজেলকে ক্রমশ সরু করে ডিসপ্লের সাইজ বাড়াতে শুরু করেছে ফোন কোম্পানিগুলি। 



এজ টু এজ ডিসপ্লে


বেজেল-কে ক্রমশ সরু করতে করতে এখন প্রায় সুতোর মতো সরু করে ফেলা হয়েছে। এর ফলে স্মার্ট ফোনের ডিসপ্লে সম্পর্কে টেকনোলজির দুনিয়ায় নতুন যে শব্দটি প্রচলিত হয়েছে তা হল এজ টু এজ ডিসপ্লে (Edge to edge display)। অর্থাৎ ফোনের বেজেল এতটাই সরু যে মনে হবে ফোনের সামনের বাঁ প্রান্ত থেকে ডান প্রান্ত পর্যন্ত পুরোটাই স্ক্রিন বা ডিসপ্লে।


নচ ডিসপ্লে


এজ টু এজ ডিসপ্লের ক্ষেত্রে ফোনটিকে যদি প্রোর্ট্রেট মোডে (সঙ্গের ছবিটি দেখুন) ধরেন, তাহলে ফোনের বাঁ প্রান্ত থেকে ডান প্রান্ত পর্যন্ত পুরোটাই স্ক্রিন। কিন্তু নীচ থেকে উপর প্রান্ত পর্যন্ত তেমনটা নয়। এর কারণ ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা বা সেলফি ক্যামেরা
Image Credit: Pixabay
এবং সেনসর। ক্যামেরা ও সেনসরকে যেহেতু স্ক্রিনের উপর থেকে সরানো সম্ভব নয়, তাই সেখানে বেজেলকেও একেবারে সরু করা সম্ভব নয়। 

এই সমস্যার সমাধানে অ্যাপল গতবছর তাদের আইফোন এক্স হ্যান্ডসেটে নচ ডিসপ্লে চালু করেছে। ফোনের স্ক্রিনের উপরে ঠিক যতটুকু জায়গা ক্যামেরা ও সেনসরের জন্য প্রয়োজন সেই অংশটুকু বাদ দিয়ে বাকি অংশ থেকে বেজেলকে সরিয়ে দেওয়া (এই লেখার সঙ্গে আইফোনের ছবিটি দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে) হয়েছে। এর জেরে ডিসপ্লের সাইজ কিছুটা বেড়েছে। 
অনেকেই খুশি নন

কিন্তু নচ ডিসপ্লে নিয়ে অ্যাপলের অনেক ক্রেতাই খুশি নন। কারণ নচ ডিসপ্লের জন্য অ্যাপলকে ফোনের টপ স্ট্যাটাস বারে কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছে। ফোনের ডিসপ্লের একেবারে উপরে থাকে স্ট্যাটাস বারে টাইম, সিগন্যাল বার, ব্লুটুথ ও WiFi আইকন ইত্যাদি থাকে। কিন্তু নচ ডিসপ্লের ক্ষেত্রে স্ট্যাটাসবারের আইকনগুলিকে নচের দুইপাশে ঠাসাঠাসি করে জায়গা দেওয়া হয়েছে। আইফোনের নচের ডানদিককে বলা হয় রাইট শোলডার যেখানে রয়েছে ব্যাটারি, সিগন্যাল ও WiFi আইকন। আর বাঁ দিকের শোলডারে রয়েছে টাইম। 

এছাড়া অধিকাংশ অ্যাপ এখনও নচ ডিসপ্লে সাপোর্ট করছে না। ফলে সেই সমস্ত অ্যাপ ব্যবহার করার সময় ডিসপ্লের উপরে এবং নীচে অ্যাপের হোম স্ক্রিন অনেকটা কেটে যাচ্ছে। তা ছাড়া এতদিন নচের জন্য ইউটিউবের ভিডিয়ো দেখতেও সমস্যা হচ্ছিল আইফোনে। ভিডিয়ো দেখার সময় নচের জন্য স্ক্রিনের দুইপাশে ছবি কেটে যাচ্ছিল। সম্প্রতি গুগল তাদের ইউটিউব অ্যাপটিকে আপডেট করেছে অর্থাৎ অ্যাপটিকে নচ কমপ্যাটিবল করেছে। এখন আর আইফোনে ইউটিউব দেখতে সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু গুগলের আরও অনেক অ্যাপ রয়েছে যেগুলি এখনও নচ কমপ্যাটিবল নয়। 


অন্ধ অনুকরণ


এখন প্রশ্ন হল, গুগল নিজেই এখনও তাদের সমস্ত অ্যাপকে নচ কমপ্যাটিবল করে উঠতে পারেনি। এছাড়া প্লে স্টোরে কয়েক লক্ষ অ্যাপ রয়েছে যেগুলি এখনও নচ কমপ্যাটিবল নয়। তা ছাড়া অ্যাপল নচ ডিসপ্লে চালু করলেও এখনও অনেক ক্রেতা এই ডিসপ্লে নিয়ে খুশি নন। সেক্ষেত্রে অ্যাপল আগামীতে নচ ডিসপ্লে ফোন থেকে সরিয়ে দিতে পারে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন শুধুমাত্র আইফোনকে নকল করার জন্য নচ ডিসপ্লে নিয়ে গুগল কেন এই মাতামাতি শুরু করল, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে টেকনোলজির দুনিয়ায়। আরও একটা প্রশ্ন হল, আইফোনের স্ট্যাটাস বারে অল্প কিছু ডিফল্ট আইকন থাকে যেগুলিকে নচের দুইপাশের শোলডারে (ঠাসাঠাসি করে হলেও) জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু অ্যান্ড্রয়েড ফোনের স্ট্যাটাসবারে আইকনের সংখ্যা বেশি। সেগুলির সবকটিকে কীভাবে নচের দুইপাশের শোলডারে জায়গা দেওয়া সম্ভব তা বোঝা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে স্ট্যাটাসবারের ডিফল্ট ডিসপ্লে থেকে অনেক আইকনকে অবশ্যই বাদ দিতে হবে। 


পিছিয়ে নেই চিনের ফোন


আইফোনের অনুকরণে গুগল নচ ডিসপ্লে নিয়ে মেতে উঠলেও দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি স্যামসাঙ কিন্তু এক্ষেত্রে যথেষ্ট আত্মমর্যাদা দেখিয়েছে। স্যামসাঙ জানিয়েছে, তাদের ডিসপ্লে সেটিংসের কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। অর্থাৎ স্যামসাঙের ফোনে নচ ডিসপ্লের বদলে স্ক্রিনের উপরে বেজেল থাকছে। কিন্তু গুগলের পাশাপাশি চিনের ফোন কোম্পানিগুলি (যারা অন্যকে নকল করা শিল্পে পরিণত করেছে) নচ ডিসপ্লে নিয়ে মেতে উঠেছে। ইতিমধ্যেই চিনের ওয়ানপ্লাস সিক্স, হুয়েই, ভিভো নচ ডিসপ্লের ফোন বাজারে লঞ্চ করেছে। 


টেকনোবিটসের এই ব্লগটি পড়ে যদি ভালো লাগে তবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করুন। কমেন্ট করুন ব্লগের নীচে বা টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে।


টেকনোবিটসের ব্লগগুলি যদি নিজের ফেসবুক নিউজ ফিডে পেতে চান, তবে টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে গিয়ে Follow বাটন ক্লিক করে তারপর See first অপশনটিতে ক্লিক করুন। ইমেল সাবস্ক্রিপশনের  জন্য টেকনোবিটসের ব্লগ সাইটে নিজের ইমেল আইডি সাবমিট করে রেজিস্ট্রেশন করুন। ধন্য়বাদ। 



6 comments:

  1. বেজেল ও নচ সন্মন্ধে জানলাম ।খুব ভালো

    ReplyDelete
  2. নতুন জিনিস জানলাম ।

    ReplyDelete
  3. অনেকদিন পর তোমার লেখা পড়লাম।

    ReplyDelete
  4. নচ সিষ্টেম আমার পছন্দ নয়।এটা স্কিনকে একেবারে অসস্তিকর সাইজ করে তুলেছে।ভিডিও দেখতে গেলে দুই পাশে কেটে যায়।

    ReplyDelete

জনপ্রিয় পোস্ট