Image Credit: Pixabay |
আমাদের অনেকেরই এমন ধারণা রয়েছে যে, এই যুগটা বোধহয় স্মার্টফোনের। স্টিভ জোবসের নেতৃত্বে অ্যাপল ২০০৭ সালে লঞ্চ করেছিল প্রথম স্মার্ট ফোন (আইফোন)। আমরা মনে করি ২০০৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে স্মার্ট ফোনের যুগ আর ফিচার ফোন চলে গিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু আমাদের সেই ধারণা ভুল।
ধারণাটা ভুল
ফিচার ফোন মানে ছোট VGA স্ক্রিন আর তার নীচে সারি সারি বোতাম। যে ফোন দিয়ে শুধু কাউকে ফোন করা যায় কিংবা SMS পাঠানো যায়। ইন্টারনেট সার্ফিং, হোয়াটস্অ্যাপ, ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখা? – ধুর, ওসব আবার ফিচার ফোনে হয় নাকি? -- ফিচার ফোন বলতে টেকনোবিটসের অধিকাংশ পাঠকদের নিশ্চয় এমনটাই ধারণা? কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আরও একটি ভুল ধারণা হল, ফিচার ফোন আজকাল দু-একজন বয়স্ক লোক আর গ্রামের দরিদ্র লোকজন ছাড়া কেউ কেনে না।
নীচের তথ্যটি পড়ুন
ভারতবর্ষে শহরের বাসিন্দাদের ৮৫ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। এই বাসিন্দাদের অধিকাংশ অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ কিন্তু স্মার্ট ফোন নয়, ফিচার ফোন (হ্যাঁ, বোতাম টেপা ফোন) ব্যবহার করেন। ভাবছেন, যাঁরা ফিচার ফোন ব্যবহার করেন তাঁরা আসলে টাকার অভাবে স্মার্ট ফোন কিনতে পারেন না? এই ধারণাটাও ভুল। কারণ যে ৮৫ শতাংশ লোক ফিচার ফোন ব্যবহার করেন তাঁদের ৭৫ শতাংশই মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থাৎ তাঁদের মাসিক উপার্জন যথেষ্ট বেশি।
আরও তথ্য
২০১৭ সালে ভারতে ১৬ কোটি ফিচার ফোন বিক্রি হয়েছে। আর আমাদের দেশে মোট ফিচার ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা (গত বছরের হিসেব অনুযায়ী) প্রায় ৪৫ কোটি। কিন্তু স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা তার অনেক কম - ২৯ কোটি। (তথ্য সূত্র: কাউন্টারপয়েন্ট)
জিও এবং স্যামসাঙ
এবার আরও একটি অবাক করা তথ্য পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করছি। গত বছরের মার্চ পর্যন্ত আমাদের দেশে ফিচার ফোনের বাজারে জিও-র কোনও অস্তিত্বই ছিল না। তখন স্যামসাঙ কোম্পানি ছিল এক নম্বরে। কিন্তু এবছর মার্চের মধ্যে দেশে ফিচার ফোনের বাজারে জিও-র মার্কেট শেয়ার ৩৫.৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের এপ্রিল থেকে এবছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে যত ফিচার ফোন বিক্রি হয়েছে তার ৩৫.৮ শতাংশই জিও-র ফোন, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্যামসাঙ।
কারণ হল KaiOS
আমাদের দেশে জিও-র হাত ধরে ফিচার ফোনের বিক্রি ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু এর কারণটা কী? কারণটা কিন্তু জিও সস্তায় ফোন বিক্রি করছে তা নয়, কারণটা হল KaiOS। এটি এমন এক অপারেটিং সিস্টেম যা শুধু ফিচার ফোনের সংজ্ঞাটাই পালটে দেয়নি, তার সঙ্গে গুগলের অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমকেও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
শুরুটা করেছিল মোজিলা
২০১৩ সালে মোজিলা কোম্পানি ফায়ারফক্স অপারেটিং সিস্টেম লঞ্চ করেছিল। মোজিলার উদ্দেশ্য ছিল কম দামের ফিচার ফোনে এই অপারেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে সেই সমস্ত সুবিধা দেবে যা শুধু স্মার্ট ফোনে পাওয়া যায়। কিন্তু অ্যাপ ডেভেলপার এবং মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলির সঙ্গে মোজিলার ব্যবসায়িক সমঝোতা ঠিকঠাক না হওয়ায় ২০১৫ সালেই ফায়ারফক্স অপারেটিং সিস্টেম বন্ধ করে দেয় মোজিলা।
নতুন করে শুরু
সেই ঘটনার দুইবছর পর অর্থাৎ ২০১৭ সালে সেই ফায়ারফক্স অপারেটিং সিস্টেমের কিছুটা রদবদল করে নতুন অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করে আমেরিকার সান ডিয়েগো শহরের একটি ছোটো কোম্পানি যার নাম KaiOS Technologies। ফায়ারফক্স অপারেটিং সিস্টেমের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েছিল KaiOS Technologies-এর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার সিবাস্টিয়েন কোডভিল (Sebastien Codeville)। তাই তিনি OEM (Original Equipment Manufacturer-যে সমস্ত কোম্পানি মোবাইল ফোন ও অ্যাকসেসরি তৈরি করে বা সেগুলি বাজারে বিক্রি করে) বাছাই করার ক্ষেত্রে বা তাদের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ব্যবসায়িক বুদ্ধির পরিচয় দেন।
এক বছরেই ৩ কোটি
KaiOS Technologies-এর OEM পার্টনার হল রিলায়েন্স জিও, মাইক্রোম্যাক্স, এইচএমডি গ্লোবাল (নোকিয়ার ৮১১০ ফোন), অ্যালকাটেল ইত্যাদি। অর্থাৎ এই সমস্ত কোম্পানি তাদের ফিচার ফোনগুলিতে KaiOS ইনস্টল করে বিক্রি করবে। সিবাস্টিয়েনের এই বিজনেস পলিসি মাত্র এক বছরে KaiOS -কে অভাবনীয় ব্যবসায়ীক সাফল্য দিয়েছে। গত এক বছরের মধ্যে আমেরিকা, কানাডা এবং ভারতে ৩ কোটি KaiOS ফিচার ফোন বিক্রি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই সংখ্যাটা চলতি বছরের শেষে ১০ কোটিতে পৌঁছে যাবে।
অ্যান্ড্রয়েডকে চ্যালেঞ্জ
ভারতে ২০১৭ সালের প্রথম তিন মাসে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের মার্কেট শেয়ার ছিল ৮৩ শতাংশ। KaiOS – এর মার্কেট শেয়ার ছিল শূন্য শতাংশ। অর্থাৎ ওই সময় যত ভারতীয় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন তাঁদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৮৩ জনের ফোনেই অ্যান্ড্রয়েড ওএস ছিল। কিন্তু ছবিটা এবছর অনেকটাই পালটে গিয়েছে। ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসের হিসেব বলছে, ভারতে অ্যান্ড্রয়েডের মার্কেট শেয়ার কমে হয়েছে ৭১.৬ শতাংশ এবং KaiOS-এর মার্কেট শেয়ার শূন্য থেকে একলাফে বেড়ে হয়েছে ১৫ শতাংশ।
কেন জনপ্রিয়?
কেন KaiOS ফিচার ফোনের এই জনপ্রিয়তা? এর কারণ এই অপারেটিং সিস্টেমের সাহায্যে সাধারণ ফিচার ফোনেই আপনি ব্যবহার করতে পারবেন গুগল সার্চ, গুগল ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, গুগল ম্যাপ, ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার, এমনকী হোয়াটসঅ্যাপ। শুধু তাই নয়, KaiOS ফিচার ফোনে আপনি 4G LTE প্রযুক্তিতে ভিডিয়ো কল করতে পারবেন। NFC (যে প্রযুক্তি মিড রেঞ্জের অনেক অ্যান্ড্রয়েড ফোনেও থাকে না) প্রযুক্তির সাহায্যে ডিজিটাল পেমেন্ট করতে পারবেন। পাবেন GPS সুবিধাও। কিন্ত এতো সবে শুরু। সিবাস্টিয়েন কোডভিল জানিয়েছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে KaiOS ফিচার ফোনগুলিতে আরও অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে যা এখন শুধু হাইএন্ড স্মার্টফোনেই পাওয়া যায়। KaiOS – এর আরও একটি সুবিধা হল এই অপারেটিং সিস্টেম খুবই কম মেমরিতে কাজ করে। এটি কাজ করার জন্য ফোনে ন্যূনতম ২৫৬ MB ব়্যাম এবং ৪ GB মেমরি প্রয়োজন। তাই দিন দিন বাড়ছে KaiOS – এর জনপ্রিয়তা।
চুক্তি করল গুগল
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছে – If you can’t beat them, join them। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ যদি এতটাই শক্তিশালী হয় যে তুমি তাকে হারাতে পারবে না, তবে তার সঙ্গে অনর্থক লড়াই না করে সেই প্রতিপক্ষের দলেই তুমি যোগ দাও। গুগলও তাই করেছে। KaiOS-এর জনপ্রিয়তা যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামীতে অ্যান্ড্রয়েডকে কঠিন লড়াইয়ের মুখে পড়তে হবে, তা বুঝেছে গুগল। তাই লড়াই করার পরিবর্তে KaiOS Technologies -এর সঙ্গে ব্যবসায়িক সমঝোতা করে ফেলেছে গুগল। দুটি কোম্পানির মধ্যে চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুসারে KaiOS Technologies -কে প্রায় দেড়শো কোটি টাকা দিয়েছে গুগল। এই টাকা KaiOS Technologies তাদের অপারেটিং সিস্টেম KaiOS-কে আরও উন্নত করার কাজে খরচ করবে। আর তার বদলে আগামীতে KaiOS ফিচার ফোন গুগলের সমস্ত অ্যাপ সাপোর্ট করবে – এটাই গুগলের লাভ।
nice sir. go on.
ReplyDelete