4 Apr 2018

ব্লু হোয়েলের থেকেও ভয়ংকর ব্লু লাইট

দিল্লির এক যুবকের চোখে কোনও সমস্যা ছিল না। কোনও দিন চশমা পরতে হয়নি। কিন্তু একদিন হঠাৎ সে দেখল রাস্তার ওপারে সাইনবোর্ডের বড় হরফের লেখাগুলি পড়তে সমস্যা হচ্ছে। পাড়ার এক 
Photo Courtesy: Pixabay

চোখের ডাক্তারের কাছে সে গেল। ডাক্তার চোখ পরীক্ষা করে বললেন, ‘পাওয়ার হয়েছে। চশমা লাগবে।’ কিন্তু চশমা পরেও সমস্যা মিটল না। এবার আরও বড় এক চোখের ডাক্তারের কাছে সে গেলসেখানে একাধিক টেস্টের পর ধরা পড়ল যুবকটি ক্রমশ তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছে, কারণ তার চোখে ক্যান্সার হয়েছে।


দিল্লির যুবকটি একা নয়গত কয়েক বছরে ভারতের মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কলকাতা থেকে শুরু করে সাগরপারে আমেরিকা সহ বিশ্বের অনেক দেশের অনেক শহরেই এমন একাধিক ঘটনা সামনে এসেছে। দেশ বা শহর আলাদা হলেও তাঁদের প্রত্যেকের রোগের কারণটা কিন্তু এক, আর সেটা হল ব্লু লাইট বা নীল আলো। 


কিন্তু টেকনোবিটসের পাতায় হঠাৎ ব্লু লাইট নিয়ে আলোচনা কেন? সেই বিষয়ে আসছি, তবে তার আগে পাঠকদের সংক্ষেপে জানাতে চাই, আমাদের জীবনে তথা স্বাস্থ্যের পক্ষে নীল রঙের আলোর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

বেনীআসহকলা


আমরা সবাই জানি যে, মূলত সাতটি রঙের আলো রয়েছেসেগুলি হল — বেগুনী, নীল, আশমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা এবং লাল। এই সাতটি রঙকে সংক্ষেপে বলা হয় বেনীআসহকলা বা ইংরেজিতে VIBGYOR (Violet, Indigo, Blue, Green, Yellow, Orange, Red) কিন্তু আরও দুটো রঙ বাকি থাকলো — সাদা এবং কালো। সাদা কোনও রঙ নয়, এটি আসলে ওই সাতটি আলোর সমষ্টি। যখন কোনও বস্তু থেকে ওই সাতটি আলো একসঙ্গে আমাদের চোখে প্রবেশ করে, তখন বস্তুটিকে আমরা সাদা দেখি। একই ভাবে যখন কোনও বস্তু থেকে সাতটি রঙের আলোর কোনওটি আমাদের চোখে প্রবেশ করে না, তখন আমরা বস্তুটিকে কালো দেখি। 

এবার প্রশ্ন হল আলো কী?



আলো হল তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ। প্রতিটি আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলাদা। যে আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যত কম, সেই আলোর শক্তি তত বেশি। আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যকে ন্যানোমিটারে (nm) মাপা হয়। এক ন্যানোমিটার হল এক মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ। বেনীআসহকলা-র মধ্যে সবচেয়ে কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হল বেগুনির এবং তারপরেই নীল আলোর। 
This image is a property of teknowbits.blogspot.com

সুতরাং বলা যেতে পারে, বেগুনি আলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এনার্জি বা শক্তি থাকে, তারপরেই শক্তির পরিমাণের দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নীল আলো। নীল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ৩৮০-৫০০ ন্যানোমিটার। আলোর ধর্ম হল, যে আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যত কম, সেই আলো তত বেশি বিচ্ছুরিত বা বিক্ষিপ্ত হয়। সূর্য থেকে পৃথিবীতে যে আলো আসে তাতে বেনীআসহকলা-র সাতটি আলোই থাকে। কিন্তু তার মধ্যে বেগুনি ও নীল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম বলে সেগুলি বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের অণু ও ধূলিকণার দ্বারা বেশি বিক্ষিপ্ত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পৃথিবীতে আমাদের চোখে অন্যান্য রঙের আলোর তুলনায় বেগুনি ও নীল রঙের আলো বেশি পরিমাণে প্রবেশ করে। 

কিন্তু মজার ব্যাপার হল, আমাদের চোখের রেটিনার ‘কোন’ কোষ (যা রঙ বুঝতে সাহায্য করে)মূলত নীল, লাল ও সবুজ রঙের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। তাই বেগুনি ও নীল আলো বেশি পরিমাণে আমাদের চোখে প্রবেশ করলেও নীল রঙটি আমাদের রেটিনা বেশি পরিমাণে গ্রহণ করে, তাই আমাদের মনে হয় আকাশ নীল।


নীল আলোর প্রভাব


আগেই বলেছি যে, নীল আলো খুবই শক্তিশালী, অর্থাৎ এর মধ্যে শক্তি বা এনার্জির পরিমাণ খুবই বেশি। তাই আমাদের শরীরের উপর এই আলোর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।

উপকার


পৃথিবীতে নীল আলোর সবচেয়ে বড় উৎস হল সূর্য। তাই দিনের বেলা সূর্য থেকে নীল আলো সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আমাদের শরীরের উপর এসে পড়ে। দিনের বেলা এই নীল আলো আমাদের শরীরে ও মনের পক্ষে উপকারী। দিনের বেলা নীল আলো আমাদের একাগ্রতা বাড়ায়, যে কোনও কাজ করার ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে এবং মানসিকভাবে আমাদের প্রফুল্ল রাখে। অনেকের কাছে মেঘলা আকাশ মানেই মন খারাপের দিন। এটা আর কিছুই নয়, নীল রঙের আলোর অভাবে তাঁদের মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশন আসে। 

অপকার


নীল আলোর প্রভাবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এটি দিনের বেলা আমাদের শরীরের পক্ষে যতটা ভালো, রাতে ঠিক ততটাই খারাপ। রাতে যদি বেশিক্ষণ নীল আলো আমাদের চোখে প্রবেশ করে বা আমরা নীল আলোর সংস্পর্শে থাকি, তবে আমাদের সার্কেডিয়ান সাইকেলে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।

সার্কেডিয়ান সাইকেল কী?



আমাদের শরীরের কাজকর্ম একটি নির্দিষ্ট নিয়মে চলতে চায়। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময় তার ঘুম প্রয়োজন, নির্দিষ্ট সময় তার ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ বা ডিনার প্রয়োজন ইত্যাদি। এই নিয়মে চলার জন্য শরীর গোটা দিনটিকে নির্দিষ্ট কতগুলি সময়ে ভাগ করে নেয়, একে বলে সার্কেডিয়ান সাইকেল। আমরা যদি পাখিদের লক্ষ্য করি, তাহলে দেখবো যে, তারা ঘড়ি দেখতে না জানলেও প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠে, আবার বিকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাসায় ফিরে আসে। এটা সার্কেডিয়ান সাইকেলের প্রভাবে হয়। আমাদের শরীরে সার্কেডিয়ান সাইকেল নিয়ন্ত্রণ করে মেলাটোনিন নামে একটি হরমোন। 
Photo Courtesy: Pixabay

সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, রাতে যদি আমরা বেশিক্ষণ নীল আলোর সংস্পর্শে থাকি, তবে আমাদের শরীরে মেলাটোনিন হরমোনের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে আমাদের সার্কেডিয়ান সাইকেলের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে অর্থাৎ সার্কেডিয়ান সাইকেল তার নিজস্ব নিয়মে চলতে পারে না। তার জেরে হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস, হঠাৎ মোটা হয়ে যাওয়া এবং ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।

নীল রঙের আলোর উৎস


দিনের বেলা নীল রঙের আলোর প্রধান উৎস হল সূর্য, যা আমাদের কোনও ক্ষতি করে না। কিন্তু রাতের বেলা নীল রঙের আলোর উৎসগুলির অন্যতম হল কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের স্ক্রিন। তাই রাতে যদি আমরা নিয়মিত কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকি, তবে তা আমাদের শরীরের পক্ষে প্রচণ্ড ক্ষতিকর। এই লেখার শুরুতে যে যুবকটির কথা বলেছিলাম, তার ক্যানসারের অন্যতম কারণ হল মোবাইল স্ক্রিন থেকে বের হওয়া ব্লু লাইট বা নীল আলো।

তাহলে উপায়?


যদি পেশাগত কারণে আপনাদের রাতের কম্পিউটারে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে হয়, তবে তাঁরা ব্লু লাইট ব্লকার গ্লাস অর্থাৎ নীল আলো প্রতিরোধকারী চশমা (অ্যান্টিগ্লেয়ার গ্লাস নয়, এটি কিন্তু নীল আলো প্রতিরোধ করতে পারে না) ব্যবহার করুন। চোখ নিয়ে হেলাফেলা না করাই ভালো। তাই নামী কোম্পানির ব্লু লাইট ব্লকার গ্লাস ব্যবহার করা উচিত। ভারতে কোন কোন কোম্পানি ব্লু লাইট ব্লকার গ্লাস বিক্রি করে, তা ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখে নিতে পারেন।

গুগল কোম্পানি তাদের অ্যান্ড্রয়েড নূগা এবং ওরিঅ ওএস বেসড্ পিক্সল ফোনে ব্লু লাইট ব্লক করার অপশন অ্যাড করেছে। ফোনের সেটিংসে গিয়ে পরপর ট্যাপ করু Display > Night Light এবং ব্লু লাইট ফিল্টার অপশনটি অন করুন।

যাঁরা আইফোন (iOS 9.3 বা তার পরবর্তী ভার্সনের ওএস) ব্যবহার করেন, তাঁরা ফোনে নাইট মোড অন করে নিন।//যাঁরা পিক্সল বা আইফোন ফোন ব্যবহার করেন না, তাঁরা ব্লুলাইট ফিল্টার অ্যাপটি ব্যবহার করতে পারেন। টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজের ‘ডাউনলোড’ অপশনে অ্যাপটির লিংক দেওয়া আছে।

 পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।


No comments:

Post a Comment

জনপ্রিয় পোস্ট