21 Nov 2017

গুগল ব্যান করলো ইউসি ব্রাউজার


Photo credit : Pixabay

আমাদের দেশে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় মোবাইল ফোন ব্রাউজার কী? উত্তরটার জন্য কোনো বিশেষ পুরস্কার নেই। কারণ সবাই জানে যে, উত্তরটা হল গুগল ক্রোম ব্রাউজার। কিন্তু দ্বিতীয় স্থানে কে রয়েছে? এই উত্তরটাও অবশ্যই সবার জানা — ইউসি ব্রাউজার।




⇒ গ্রাহক সংখ্যা 

ইউসি ব্রাউজার বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫০ কোটি মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত হয় এবং তার মধ্যে শুধু ভারতেই ১০ কোটি মোবাইল ফোনে এই ব্রাউজারটি ইতিমধ্যে ইনস্টলড হয়েছে। অর্থাৎ ইউসি ব্রাউজারের মোট গ্রাহকের পাঁচ ভাগের এক ভাগই হল আমাদের দেশে। কিন্তু সম্প্রতি এই ব্রাউজারটির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ উঠেছে, যার জেরে গুগল কোম্পানি তাদের প্লে স্টোর থেকে ইউসি ব্রাউজারকে ব্যান করে দিয়েছে। কী সেই অভিযোগ? অভিযোগটি যথেষ্ট গুরুতর এবং তার সঙ্গে ভারতের স্বার্থ বিশেষ ভাবে জড়িত।

⇒ কেন এত জনপ্রিয়

অভিযোগটি কী সেই সম্পর্কে পাঠকদের বলার আগে সংক্ষেপে জেনে নেই ইউসি ব্রাউজারটি কেন এত জনপ্রিয়। 
ইউসি ব্রাউজারটির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হল এটি অন্যান্য ব্রাউজারের তুলনায় অনেক ফাস্ট অর্থাৎ দ্রুত কাজ করে এবং একই সঙ্গে গ্রাহকের মোবাইল ফোনের ডেটা খরচও কমায়। অর্থাৎ এই ব্রাউজার ব্যবহার করলে দুই দিক দিয়েই গ্রাহকের সুবিধা।

⇒ ইউসি ব্রাউজার কেন ফাস্ট? 

এর কারণ হল আমরা যখন ইউসি ব্রাউজারের মাধ্যমে কোনো ওয়েবসাইটে যাই তখন এই ব্রাউজারের সার্ভার ওয়েবসাইট এবং গ্রাহকের মধ্যে প্রক্সি হিসাবে কাজ করে অর্থাৎ আমরা যে ওয়েব পেজটি অ্যাকসেস করতে চাচ্ছি, ইউসি ব্রাউজারের সার্ভার সেই ওয়েব পেজটি প্রথমে নিজে অ্যাকসেস করে, তারপর সেটিকে ডেটা কমপ্রেশন পদ্ধতিতে কমপ্রেস করে এবং তারপর সেটি গ্রাহকের মোবাইলে পাঠায়। তাই একদিকে যেমন ওয়েব পেজ অর্থাৎ ওয়েব পেজের ডেটা কমপ্রেস করার ফলে পেজের সাইজ অনেকটাই ছোটো (আকারে নয়, ডেটার পরিমাণের দিক দিয়ে) হয়, ফলে নেটওয়ার্ক কানেকশন যতই দুর্বল থাকুক না কেন, সেই পেজটি খুব দ্রুত মোবাইল ফোন অ্যাকসেস করতে পারে, অন্যদিকে, কমপ্রেশনের ফলে পেজের মধ্যে ডেটার পরিমাণ কমে যাওয়ায় গ্রাহকের নেট প্যাকের ডেটা খরচও কম হয়।
এছাড়া ইউসি ব্রাউজারের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হল এটির ডাউনলোড ফিচার। এই ব্রাউজারের ডাউনলোড ফিচারের সাহায্যে বিভিন্ন ফরম্যাটের ফাইল ডাউনলোড করা সম্ভব। এছাড়া ব্রাউজারটির ডাউনলোড ফিচার ফাইল ডাউনলোডিংয়ের সময় মাল্টিপল থ্রেড কানেকশন ডাউনলোড টেকনিক ব্যবহার করে। এই টেকনিকে কোনো ফাইলকে ইন্টারনেট থেকে অনেক দ্রুত ডাউনলোড করা সম্ভব। এই প্রসঙ্গে পাঠকদের জানিয়ে রাখি যে, ইন্টারনেট ডাউনলোড ম্যানেজারও (আইডিএম) এই টেকনোলজি ব্যবহার করে, তাই আইডিএম-এর সাহায্যে অন্যান্য ডাইনলোডারের তুলনায় অনেক দ্রুত ফাইল ডাউনলোডিং সম্ভব।

⇒ কেন ব্যান করা হল?

ইউসি ব্রাউজার যখন এত জনপ্রিয়, এই ব্রাউজারে যখন এত ভালো ভালো ফিচার রয়েছে, তাহলে কেন এটিকে গুগল তাদের প্লে স্টোর থেকে ব্যান করে দিল?
ইউসি ব্রাউজারটি তৈরি করেছে চিনের মোবাইল ইন্টারনেট কোম্পানি ইউসি ওয়েব। বর্তমানে এই কোম্পানি আলিবাবা গ্রুপের অধীনে। চিনে তৈরি মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে সফট্ওয়্যার—কোনো কিছুই সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। অধিকাংশের বিরুদ্ধেই নানা সময় গ্রাহকদের তথ্য চুরির একাধিক অভিযোগ উঠেছে। ইউসি ব্রাউজারও দীর্ঘদিন ধরে ভারত সহ বিভিন্ন দেশের নজরদারির আওতায় ছিল। ইউসি ব্রাউজার যে গ্রাহকদের মোবাইল ফোনের থেকে বিভিন্ন তথ্য চুরি করে, সেই বিষয়টি প্রথম ফাঁস করেছিলেন এডওয়ার্ড স্নোডেন। স্নোডেন বেশ কয়েক বছর আগে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র একটি বিশেষ বিভাগ এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি)-র হয়ে কাজ করতেন। এনএসএ-র কাজ হল বিভিন্ন ব্রাউজার, অপারেটিং সিস্টেম সহ বিভিন্ন সফটওয়্যারের ত্রুটি খুঁজে বের করা এবং সেগুলির সাহায্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোকজনের মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার হ্যাক করে নজরদারি চালানো। স্নোডেন প্রথম ফাঁস করেছিলেন কীভাবে এনএসএ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নজরদারি চালায়। তারপর থেকেই সিআইএ তাঁকে খুঁজছে। স্নোডেন এখন আমেরিকা থেকে পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। স্নোডেন এনএসএ-র কাজকর্ম ফাঁস করার সময় ইউসি ব্রাউজারের প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, এই জনপ্রিয় ব্রাউজারের সাহায্যে খুব সহজেই গ্রাহকের মোবাইল ফোন থেকে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি করা সম্ভব।
স্নোডেনের সেই অভিযোগের পর কানাডার মাঙ্ক স্কুল অফ গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স-এর সিটিজেন ল্যাবের বিশেষজ্ঞরা ইউসি ব্রাউজার পরীক্ষা করে দেখেন স্নোডেনের অভিযোগ পুরোপুরি ঠিক।

⇒ এনক্রিপশন সিস্টেম নেই 


আমরা যখন ফোনে কোনো ব্রাউজার ব্যবহার করে ইন্টারনেট সার্ফ করি, তখন সেই ব্রাউজারের সিকিউরিটি সিস্টেম আমাদের মোবাইল ফোন নম্বর, ফোনের IMEI (International Mobile Equipment Identity)নম্বর, আমাদের লোকেশন, আমরা ইন্টারনেটে কী কী সার্চ করছি ইত্যাদি সমস্ত ডেটা এনক্রিপট করে রাখে, যাতে আমরা যে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ইন্টারনেট সার্ফ করছি সেই নেটওয়ার্ক হ্যাক করেও হ্যাকাররা আমাদের সেই সমস্ত তথ্য জানতে না পারে। কিন্তু সিটিজেন ল্যাবের কম্পিউটার বিশেষজ্ঞরা দেখলেন যে, ইউসি ব্রাউজারে এই ধরণের কোনো এনক্রিপশন সিস্টেমই কার্যত নেই। ফলে আমাদের ফোনের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কোনো হ্যাকার সহজেই হ্যাক করতে পারবে।

ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের তদন্ত 

এবার যে গুরুতর প্রশ্নটি উঠেছে, তা হল চিনের ইউসি ব্রাউজারের সিকিউরিটি সিস্টেমের এই ত্রুটি কী ইচ্ছাকৃত? তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের এক আধিকারিক কিন্তু তেমনটাই বলছেন। স্নোডেনের অভিযোগের পর বসে ছিল না ভারতও। আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকও ইউসি ব্রাউজারের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছিল। আর সেই পরীক্ষার পর ইউসি ব্রাউজারের সিকিউরিটি সিস্টেমের ত্রুটির পাশাপাশি আর একটি যে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, তা হল ইউসি ব্রাউজারটি বর্তমানে যাদের মালিকানাধীন চিনের সেই আলিবাবা কোম্পানি নাকি ইউসি ব্রাউজার ব্যবহারকারী সমস্ত ভারতীয়দের যাবতীয় তথ্য চুরি করে চিন সরকারকে ১০০ কোটি ডলারে বিক্রি করেছে!


 আনইনস্টল করেও রেহাই নেই 

অভিযোগের এখানেই শেষ নয়। আরও যে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে (এবং আমার মতে সবচেয়ে মারাত্মক), তা হল এই ব্রাউজারটি আপনি ফোন থেকে আনইনস্টল করে দিলেও সেটির কিছু ফাইল আপনার ফোনে থেকে যাবে এবং তার সাহায্যে ইউসি ব্রাউজার আপনার ফোনের DNS (Domain Name System) সেটিংস মডিফাই করে আপনার ফোনের উপর নজরদারি চালাতে পারে। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের C-DAC (Centre for Development of Advanced Computing)-এর হায়দ্রাবাদ শাখা এখনো তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তদন্তে যদি এই অভিযোগ প্রমাণিত হয় তবে সম্ভবত ভারতে ইউজি ব্রাউজার ব্যবহার নিষিদ্ধ করবে কেন্দ্রীয় সরকার।

⇒ ব্যান করল গুগল 

গুগল অবশ্য অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁদের ইঞ্জিনিয়াররা ইতিমধ্যে ইউসি ব্রাউজারটি পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং সেই পরীক্ষায় ব্রাউজারটির সিকিউরিটি সিস্টেমে একাধিক ত্রুটি খুঁজে পাওয়ার পর বিষয়টি গুগল কোম্পানির তরফে আলিবাবা-কে জানানো হয়েছে এবং ব্রাউজারটিকে গুগল তাদের প্লে স্টোর থেকে সরিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীরা আর তাঁদের ফোনে নতুন করে ব্রাউজারটিকে ইনস্টল করতে পারবেন না। এখন যদি গুগল প্লে স্টোরে গিয়ে ইউসি ব্রাউজার টাইপ করে সার্চ করেন তবে সেখানে অরিজিনাল ইউসি ব্রাউজারের বদলে পাবেন ‘ইউসি ব্রাউজার মিনি’। কিন্তু এই ব্রাউজারটি অরিজিনাল ব্রাউজারের মতো অতো ফাস্ট নয় এবং এতে প্রচুর ‘বাগ’ অর্থাৎ সফটওয়্যার কোডিংয়ে অনেক ত্রুটি রয়েছে।

⇒ আলিবাবা কী বলছে?

আলিবাবা জানিয়েছে, তাদের ব্রাউজারের সিকিউরিটি সিস্টেমের যে সমস্ত ত্রুটি নিয়ে অভিযোগ উঠেছে সেগুলি দ্রুত তারা মেরামত করবে এবং প্লে স্টোরে নিজেদের জায়গা ফিরে পেতে নতুন করে গুগলের কাছে আবেদন করবে।


পাঠকদের প্রতি

আগে যেমন জানিয়েছি যে, এখন থেকে টেকনোবিটসের নতুন পুরানো লেখাগুলি ব্লগ সাইটে নিয়মিত পোস্ট হবে এই লেখাগুলি পড়ার জন্য এবং কমেন্ট করার জন্য আপনি সরাসরি টেকনোবিটসের ব্লগ সাইটে যেতে পারেন, কিংবা টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজে পোস্টগুলির যে লিংক দেওয়া হয়, সেই লিংকও ক্লিক করতে পারেন যদি ইমেল সাবস্ক্রিপশন করতে চান, তবে টেকনোবিটসের ব্লগ সাইটে গিয়ে নিজের মেল আইডি সাবমিট করে কনফার্ম করুন কনফার্মেশনের জন্য স্ক্রিনে একটি ক্যাপচা কোড শো করবে, সেটি টাইপ করুন তারপর আপনার মেলের ইনবক্সে বা স্প্যাম ফোল্ডারে টেকনোবিটস ব্লগ সাইট থেকে একটি কনফার্মেশন লিংক সহ মেল পাঠানো হবে সেই লিংকটি ক্লিক করে আপনাকে মেল আইডি ভেরিফাই করতে হবে ব্যস তাহলেই টেকনোবিটসের ব্লগ সাইটে যখনই কোনো নতুন লেখা পোস্ট করা হবে, আপনার মেল বক্সে সেই লেখার লিংক সহ আপডেট নোটিফিকেশন চলে যাবে এছাড়া এখনো যদি টেকনোবিটসের ফেসবুক পেজ লাইক না করে থাকেন, তাহলে সেটি লাইক করুন, সেক্ষেত্রে টেকনোবিটসের নতুন পোস্টগুলির লিংক আপনি আপনার ফেসবুক নিউজ ফিডেও পেয়ে যাবেন

8 comments:

জনপ্রিয় পোস্ট